লাইফলাইন হিসেবে খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। কিন্তু এ সড়কটির মিরসরাই ও সীতাকুন্ড অংশ এখন ডেডলাইনে পরিণত হয়েছে। এমন কোন দিন নেই চট্টগ্রামের এই দুই উপজেলার প্রায় ৭০ কিলোমিটার অংশে কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটছে না। হচ্ছে না প্রাণহানী।
এমনকি এই অঞ্চলের রেলপথও বিপদজনক। যেখানে হর-হামেশাই কাটা পড়ছে শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ ও নারীরা।এ জন্য শুধু সড়ক ও রেলপথ দায়ী নয়। দায়ী সড়কের যানবাহন চালক, দায়ী জনসাধারণের অসচেতনতা। উঠে এসেছে পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও।
সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার এই মহাসড়কে প্রাণ হারান সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট এলাকার এক চা দোকানের শিশু। পুলিশের হুকুমে দ্রুত চা আনতে গিয়ে দ্রুতগামী একটি পিকআপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় সে। এ নিয়ে পুলিশকে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত জনতা। এতে জখম হন এসআই মো. মনির ও কনস্টেবল মো. কাশেম।
অভিযোগ উঠেছে, ফৌজদারহাট টোল বক্সের সামনে ট্রাফিক পুলিশ প্রতিদিন যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি করে। ফলে চাঁদার ভয়ে পিকআপ, ভ্যান, ট্রাকসহ পণ্যবাহি যানবাহনগুলো দ্রুতগামী হয়ে উঠে। এতে ওই এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে একের পর এক।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের (উত্তর জোন) ইন্সপেক্টর সরোয়ার মো. পারভেজ সড়কে দ্রুতবেগে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করলেও অন্য আরও একাধিক কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে তথ্য উপস্থাপন করেন।
এরমধ্যে চালকদের অন্যমনষ্কতা, ওভারটেক করার প্রবণতা, সড়ক ব্যবহারবিধি স¤পর্কে চালকদের জ্ঞান না থাকা, ট্রাফিক সাইন বা সাংকেতিক চিহ্ন না থাকা, কোথাও কোথাও থাকলেও এসব সংকেত চিহ্ন স¤পর্কে চালকদের অজ্ঞতা, জনসাধারণের অসচেতনতা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনও দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম দায়ী বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, যানবাহন দ্রুতবেগে চালানো যায় যদি সড়ক নিরাপদ থাকে। এ জন্য চালককে দক্ষ হতে হবে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। আইন মেনে চলার মানসিকতা থাকতে হবে। কিন্তু সেগুলোর একটি থাকলে আরেকটি নেই। এ কারণে মহাসড়কের সর্বত্র কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে মিরসরাই-সীতাকুন্ডের ৭০ কিলোমিটার এলাকা এখন ডেডলাইন পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনা রোধে সড়কের এ এলাকায় হাইওয়ে পুলিশ, থানা পুলিশ কাজ করছে। কিন্তু আইন না মানার প্রবণতার কারণে পুলিশ যানবাহনগুলোকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বরং আইনকে ফাঁকি দিতে গিয়ে চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বার আউলিয়া থানা পুলিশের তথ্যমতে, মিরসরাই থেকে সীতাকুন্ড পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় চলতি বছরের গত ১০ মাসে ১২৩টি দুর্ঘটনায় ৩২৭ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। এ নিহতের সংখ্যা মাসে গড়ে ৩০ জনেরও বেশি। আহত হয়েছে ১০৫৯ জনেরও বেশি। পঙ্গু জীবন যাপন করছে ৪১৯ জনের মতো মানুষ।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের অক্টোবর মাসে মিরসরাই ও সীতাকুন্ড অংশে ৩২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩৯ জনের প্রাণহানী হয়েছে। আহত হয়েছে ১০৪ জন। এরমধ্যে মাসটির শেষ ১১ দিনে সড়ক দূর্ঘটনা ঘটেছে ১০ টি। এতে নিহত হয়েছে ২০ জন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের পর মাসে, মাসের পর সপ্তাহে, সপ্তাহের পর দিনে এসে সড়ক দূর্ঘটনার হার ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে প্রাণহানী, আহত ও পঙ্গুত্ব বরণের সংখ্যা।
সর্বশেষ তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, গত ৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট টোল বক্সের সামনে পিকআপ চাপায় নিহত দোকানের শিশু ছাড়াও ৩০ অক্টোবর মিরসরাই পৌরসভা সদরে বাসের ধাক্কায় নিহত হন মোটরসাইকেল চালক আফজাল। আহত হন মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা ইসমাইল। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়।
২৯ অক্টোবর ভোরে সীতাকুন্ড উপজেলার সিটি গেইট এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন প্রাইভেটকার চালক জহির উদ্দিন(৩২)। আহত হন কার আরোহী সানজিদা (৩১) ও তার শিশু কন্যা সুলতানা শারমিন(৮)
২৮ ও ২৭ অক্টোবর দু‘দিনে মিরসরাই ও সীতাকুন্ডে পৃথক দুর্ঘটনায় নিহত হন এক মাইক্রো চালক ও সিএনজি অটোরিকশা চালক। ২৬ অক্টোবর ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার পথে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় এম্বুলেন্স উল্টে গিয়ে রোগী আক্কাছ মিয়া (৬৫) ও এম্বুলেন্স চালক সানাউল্ল্যাহ (৩৪) নিহত হন।
এ সময় আহত হন আক্কাছের স্ত্রী রানী বেগম (৫৮), ছেলে মো. জাহিদ (২৭), আরেক এলাকার বাসিন্দা হালিমা বেগম (৪৫) ও কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার বাসিন্দা আবদুল কাদেরের ছেলে মো. ইসমাইল (২২)। তারা চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা।
২৫ অক্টোবর সকালে ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের দুই যাত্রী নিহত হন। ২৪ অক্টোবর ভোরে সীতাকুন্ডের বারৈয়ারহাট এলাকায় নিহত হন ইকবাল হোসেন নামে এক মোটরসাইকেল চালক। ২২ অক্টোবর মিরসরাইয়ে চাল বোঝাই একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেলে মারা যান সাত জন। ২১ অক্টোবর মহাসড়কের সীতাকুন্ডে ট্রাকের ধাক্কায় এক মোটর সাইকেল আরোহী মারা যায়।
২০ অক্টোবর ভোর ৩ টার দিকে সীতাকুন্ড উপজেলার বাড়বকুন্ড বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের সামনে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চাপায় সৌদিয়া পরিবহণের একটি বাসের যাত্রী কামরুজ্জামান মল্লিক (৩৭) ও মো. মাসুদ (৩৫) নিহত হন। এতে আহত হন আরও ১০ যাত্রী।
কামরুজ্জামান মল্লিক শরীয়তপুর জেলার গাজিয়া থানার সিকদার বাড়ির গিয়াস উদ্দিন মল্লিকের ছেলে। মাসুদের বাড়িও শরীয়তপুরের গাজিয়া থানায়। আহত ও নিহতদের সবাই তাবলিগ জামাতের বলে জানা গেছে।
সৌদিয়া পরিবহণের একটি বাসের চালক আজিজ মোল্লা এ প্রসঙ্গে বলেন, লাইফলাইন হলেও সড়কে জনসাধারণ ও যানবাহন চলাচলের পর্যাপ্ত সাংকেতিক চিহ্ন নেই। অতীতে স্থাপিত সাংকেতিক চিহ্নগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোনে কোন ক্ষেত্রে সাংকেতিক চিহ্নগুলো স¤পর্কে চালক ও জনসাধারণের জ্ঞান না থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, সড়কের অধিকাংশ স্থানে ডিভাইডার নেই। সড়কটির কোথাও কোথাও চার থেকে ছয় লেনে উন্নীত হলেও ব্যস্ততম স্থানে তা হয়নি। রাজধানীর প্রবেশপথ নিরাপদ হলেও সে অনুযায়ী চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও মিরসরাই সম্পূর্ণ অনিরাপদ ও অরক্ষিত। এক্ষেত্রে ভোরের দিকে চালকদের চোখে ঘুম আসার বিষয়টিকেও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেন তিনি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম জেলা সার্কেলের তথ্যপ্রদানকারী কর্মকর্তা শেখ মো. রোকন উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে সড়কে তিন ধরণের ট্রাফিক সাইন থাকে। তা হচ্ছে বাধ্যতামূলক চিহ্ন, সতর্কতামূলক চিহ্ন এবং তথ্যমূলক চিহ্ন। এর মধ্যে ৮ ধরনের বাধ্যতামূলক হ্যাঁ বাচক চিহ্ন, ৩২ ধরনের বাধ্যতামূলক নিষেধ চিহ্ন, ১৮ ধরনের সতর্কিকরণ চিহ্ন, ২৮ ধরনের সতর্কতামূলক চিহ্ন এবং ২৪ ধরনের তথ্যমূলক চিহ্ন রয়েছে।
সড়ক ব্যবহার বিধির আইন অনুযায়ী, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার আগে এসব সাংকেতিক চিহ্নগুলো স¤পর্কে জ্ঞান আছে কি না তা যাছাই করে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, লাইসেন্স দেওয়ার আগে সাংকেতিক চিহ্ন সংক্রান্ত জ্ঞান আছে কি না তা যাছাই করে দেখেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ কারণেই সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে জানান বিআরটিএর এই কর্মকর্তা।