বাসে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন ঘটছে এই ঘটনা। দুএকটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও বেশিরভাগ চাপা পড়ে যাচ্ছে। সাহসী কিছু নারী প্রতিবাদ করলেও বাকিরা লজ্জা ও সম্মানের ভয়ে মুখ খুলছেন না, অভিযোগও করছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েই চলেছে। তাই লোকাল বা দূরপাল্লার বাসগুলোতে নারীরা কতটা নিরাপদ সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।
বাসে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবহন মালিকদের। বিভিন্নভাবে পরিবহন শ্রমিকদের বোঝানো হচ্ছে, নারীদের হয়রানি থেকে দূরে থাকার জন্য। একই সাথে যেসব শ্রমিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠছে, পরিবহন মালিকরা তাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতিও দিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব ঘটনা তাদেরকে লজ্জায় ফেলেছে। এ নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিক পক্ষের দফায় দফায় মিটিং ও কাউন্সিলিং চলছে। জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনায় দায়ী হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। এত সব ব্যবস্থা ও পদক্ষেপের পরও কেন এমন ঘটনা ঘটছে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না বাস মালিকরা।
গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর বাসাবোর বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় লাব্বাইক বাসে দুই শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হন। পরে তারা বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশকে জানালেও কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন তারা।
গত ২১ এপ্রিল বাড্ডা এলাকা থেকে আসার সময় তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে হয়রানির শিকার হন উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পরে পুলিশ বাসের চালক ও সহকারীকে গ্রেফতার করে।
গত ২৩ এপ্রিল দুপুরে বাড্ডা লিংক রোড থেকে তুরাগ পরিবহনের বাসে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণী বিপাকে পড়েন। বাসে উঠে বুঝতে পারেন তিনি যৌন হয়রানির শিকার হতে চলেছেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে দ্রুত নেমে যেতে চান। কিন্তু বাসের হেলপার এসে তার পাশে বসেন এবং সুপারভাইজার গাড়ির চালককে খিলক্ষেতের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনে গেলে বাস থেকে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষা করেন ওই তরুণী।
২৫ এপ্রিল রাতে ঠিকানা পরিবহনের একটি বাসে আসাদগেট থেকে আজিমপুর যাওয়ার পথে যৌন হয়রানির শিকার হন এক তরুণী। তারা এক সঙ্গে মা ও মেয়ে ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মেয়েটি এক পুলিশের কনস্টেবলের কাছে সাহায্য চাইলেও কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেছিলেন ওই মেয়ে।
সর্বশেষ ১৫ মে দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় দেওয়ান পরিবহনের একটি বাসের হেলপার ও চালকের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষার্থী। ঘটনার দিন মেয়েটির পরিবার এক গণমাধ্যমে অভিযোগ করলে বিষয়টি নজরে আসে। পরদিন ওই শিক্ষার্থীর মা ও ভাইকে থানা যেতে বলে পুলিশ। এক পর্যায়ে বাসের মালিক এসে তাদের কাছে ক্ষমা চান বলে জানিয়েছে ওই মেয়েটির পরিবার। তবে এ ঘটনায় সম্মানের ভয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে রাজি হননি মেয়েটির পরিবার।
এভাবেই গণপরিবহনে প্রায় প্রতিদিনই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সব ঘটনা গণমাধ্যমে আসছে না। সম্প্রতি ব্রাকের একটি জরিপে উঠে এসেছে, গণপরিবহনে বিভিন্নভাবে ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ নারীই চলন্ত বাসে নামার সময় এবং ওঠার সময় হয়রানির শিকার হন। তবে ভয়ে তারা প্রতিবাদ করেন না। যদিও এসব ঘটনায় শতাধিক মামলা তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, গত তিন মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাসে যৌন হয়রানির ৫২টি ঘটনা ঘটেছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এমন ঘটনাগুলো আগে ঘটলে কেউ প্রতিবাদ করতো না। এমনকি থানায় অভিযোগ করতেও চাইতো না। কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। কিছু নারী সাহসী হয়ে উঠছেন। তারা এখন প্রতিবাদ করছেন। তবে বিষয়গুলোর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য বাস চালক, শ্রমিক ও মালিকদের সতর্ক থাকতে হবে।’
এদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের একটি পরিসংখ্যান বলছে, শুধু মার্চ ও এপ্রিল মাসে বাংলামোটর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত চলন্ত বাসে ৩২টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা কয়েকদিন আগে বাস মালিকদের নিয়ে বসেছিলাম। সেখানে বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়াও কেউ এমন অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ারও কথা বলা হয়েছে। তবে নগরীতে এমন ঘটনার নজরদারি করার জন্য ভ্রাম্যমাণ টিম রয়েছে।’
এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি রুস্তম আলী খান বলেন, ‘ঘটনাগুলো আমাদের পরিবহন সেক্টরকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। দুই একজন শ্রমিকের কারণে সুনাম নষ্ট হচ্ছে। আমরা এমন কাউকে কোনো অবস্থাতেই ছাড় দিব না। কাউকে হাতেনাতে পেলে দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তবে বিষয়গুলো যাতে না ঘটে তার জন্য তাদের কঠোরভাবে বলা হচ্ছে। শ্রমিকদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে।’
বেশকিছু ঘটনায় চালক ও হেলপারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে বাসে যৌন হয়রানির জন্য বাসের চালক ও হেলপারদের নেশাগ্রস্ত থাকাকে দায়ী করলেন রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বেশিরভাগ বাস শ্রমিক নেশায় আসক্ত। তারা নেশা করে গাড়িতে ডিউটি করার সময় কার সঙ্গে কি ধরনের আচরণ করতে হবে তা বুঝতে পারেন না। ফলে এমন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।’