রাজধানীর মিরপুরে থাকতেই কবিরাজি পেশার আড়ালে প্রতারণা করতেন হেমায়েত খান ওরফে জাহিদ কবিরাজ। পাঁচ বছর মিরপুরে থাকার পর জনরোষের মুখে চলে যান মোহাম্মদপুর বছিলায়। সেখানে নতুন আস্তানা গেড়ে ফের শুরু করেন প্রতারণা। এ সংক্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে র্যাব। প্রতারণার তদন্তে রোগীর ছদ্মবেশে হেমায়েত কবিরাজের দরবারে যান র্যাব সদস্য। এরপর বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতারের পর হেমায়েত কবিরাজকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় তিনি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।
র্যাব জানিয়েছে, ২০০৫ সালে বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর মনু বেগম হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ। গত ১৭ বছর ধরে তিনি দেশে ও ভারতে কবিরাজি পেশার ছদ্মবেশে পলাতক জীবনযাপন করেছেন।
গ্রেফতার হেমায়েত খান ওরফে জাহিদ কবিরাজ (৫২) পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের সামসুল হক খানের ছেলে। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের আংটি ১২৯টি, শঙ্খ ৩টি, আলাদিনের চেরাগ ১টি, ক্রেস্ট ২টি, কবিরাজি সংক্রান্ত বই ১৫টি, পিতলের পাঞ্জা ১টি ও কবিরাজি সংক্রান্ত অন্যান্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মনু হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাগেরহাটে মনু বেগম এক নারীর বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে হেমায়েতসহ ৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়। মামলার তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের জুন মাসে আদালত আসামি হেমায়েতকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
দীর্ঘদিন ধরে পলাতক এ আসামিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু র্যাব জানতে পারেনি রাজধানীতে কবিরাজি পেশার আড়ালে প্রতারণা করা হেমায়তই মনু হত্যা মামলার আসামি।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হেমায়েত জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করেন। কবিরাজি পেশার মাধ্যমে নানাভাবে মানুষের সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করতেন। তবে নারীরাই ছিলেন তার প্রতারণার মূল টার্গেট।
২০০৩ সালে তিনি তার স্ত্রী-সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজি ব্যবসা শুরু করেন। কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সোবহান।
২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান ভুক্তভোগী মনু বেগমের মাথা ব্যথার রোগকে মানসিক রোগ বলে আখ্যায়িত করে তাকে চিকিৎসার জন্য হেমায়েতের কাছে নিয়ে আসেন।
মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য মনুর নিকট টাকা পাঠাতেন। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসায় উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। কাপড়ের ব্যবসা করে এবং স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনুর নিকট এক লাখের অধিক টাকা জমা হয়। ওই অর্থ হাতিয়ে নিতে চাইতেন হেমায়েত। মনুর সরলতার সুযোগে তার টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে রোগের বাহানায় তাকে টার্গেট করেন হেমায়েত।
গ্রেফতার হেমায়েত মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যম নিয়মিত ঘুমের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে মনুকে তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা-পয়সায় শত্রু পক্ষের জিনের আক্রমণে পড়তে পারে বলে ভয় দেখান। এ জন্য তার যাবতীয় সহায়-সম্পত্তির দলিলপত্র নিরাপত্তার জন্য হেমায়েতের কাছে জমা রাখার জন্য মনুকে উদ্বুদ্ধ করেন। নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে ভুক্তভোগী মনুর ঘুম হয় এবং মাথা ব্যথার প্রবণতা কিছুটা কমে আসলে হেমায়েতের ওপর আস্থা তৈরি হয়। সরল বিশ্বাসে তার টাকা-পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েতের নিকট জমা রাখেন। এরপর মনুকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার চেষ্টা করেন হেমায়েত ও তার সহযোগী।
মনুর বাধায় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করেন। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা মরদেহ বস্তাবন্দি করে ধানখেতে লুকিয়ে রাখেন।
গ্রেফতার এড়াতে হেঁটে অবৈধভাবে ভারত যান হেমায়েত
বাগেরহাট সদর থানায় হত্যা মামলা দায়েরের খবরে পালিয়ে যশোরে একটি মাজারে আশ্রয় নেন হেমায়েত। পরদিন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে আজমির শরিফ মাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে তিনি তিনবছর অবস্থান করেন।
২০০৮ সালে পুনরায় অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করেন। পরিচয় গোপন করে লম্বা চুল ও দাঁড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে তার আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহারে নতুন এনআইডি তৈরি করেন। মিরপুরে থাকাকালীন হেমায়েত কবিরাজির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন। ভাগ্য পরিবর্তনে তাবিজ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূর করতে তাবিজ, বশীকরণ তাবিজ ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে প্রতারণা করতে থাকেন।
প্রতারণার কারণে তিনি জনরোষের মুখে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং সর্বশেষে গত ৫ বছর ধরে মোহাম্মদপুর বছিলায় বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন। বছিলায় একইভাবে তিনি কবিরাজি ব্যবসা করতে থাকেন। তাবিজ দেওয়া, জিনের বাদশার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে নতুনভাবে প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেন।
তবে তার টার্গেটে নারীরাই বেশি ছিলেন। তিনি জিনের বাদশার মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতেন।
২০১২ সালে রাজধানীর দারুস সালাম থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা ঞয়। এছাড়াও, ২০১৭ সালে তিনি তার কবিরাজি কাজে ব্যবহৃত কষ্টি পাথরের মূর্তি রাখার দায়ে চোরাকারবারি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর দেড়মাস কারাভোগ করেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোকা দেওয়ার জন্য হেমায়েত বারবার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। গত দুই মাসের মধ্যে তিনি পিরোজপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ এবং মিরপুরে অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য তিনি মাঝে-মধ্যেই তার চুল দাড়ির রং পরিবর্তন, পোশাকের ধরন পরিবর্তন করেন।