চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কর্ণফুলী থানার সিইউএফএল সংলগ্ন ডাই অ্যামোনিয়া ফসফেট (ডিএপি) প্লান্টের অ্যামোনিয়া রিজার্ভ ট্যাংক লিকেজের ঘটনায় স্থানীয় পুকুর ও জলাশয়ে মরা মাছ ভেসে উঠছে। কেবল তা-ই নয়, এখনো ১০ শতাংশ গ্যাস নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় স্থানীয় লোকজনের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ঘটনায় বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ জনের বেশি মানুষ শ্বাসকষ্ট রোগে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিটের ২০টি গাড়ি পানি ছিটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। গত সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় কেউ সেখানে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়েছে নাকি তা অন্য কোনো কারণে হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন বিসিআইসি। প্রতিষ্ঠানটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়ে কথা বলেন বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. ইকবাল। তিনি বলেন, এখনই কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেয়েছেন লোকজন। এ ঘটনায় কারও অবহেলা থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্য কেউ নাশকতা করলে তাকেও খুঁজে বের করা হবে। তবে বিস্ময় হচ্ছে, এত কঠোর নিরাপত্তা ও সতর্কতার পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটলো কিভাবে?
বিসিআইসি সূত্র জানায়, ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালককে (কারিগরি এবং প্রকৌশল) প্রধান করা হয়েছে। পাশাপাশি সদস্য হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ ও বিসিআইসির সাবেক প্রকৌশলীরা। কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরজমিন গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেই কারখানার ট্যাংকের সীমানা দেয়ালের পাশের সড়কে অ্যামোনিয়া গ্যাসের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ রয়েছে। লোকজনকে সতর্ক করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ফিতা টেনে দিয়েছে। চলছে পানি ছিটানোর কাজ। কারখানার সীমানা দেয়ালের পাশের সড়কের সঙ্গে লম্বা পুকুর বলে বিশেষ জলাশয়ে মরা মাছ ভেসে ওঠার পর স্থানীয় লোকজন তা সাংবাদিকদের দেখান।
তবে এ বিষয়ে সিইউএফএলের বিশ্রামাগারে ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল বড়ুয়া বলেন, এখানে আতঙ্কিত না হতে সবাইকে অনুরোধ করছি। আসলে পুকুরের পানি অ্যামোনিয়া গ্যাস শুষে নেয়ায় হয়তো মাছ মরে গেছে বলে আমাদের ধারণা। তবে অবশিষ্ট যেসব গ্যাস রয়েছে তা পানি ছিটিয়ে কমিয়ে ফেলা হবে বলে আশা করছি।
এ বিষয়ে কথা হয় ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিনের। তিনি বলেন, ১০ শতাংশ গ্যাস রাতের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনতে পারবো। এখন পানি ছিটানোর কাজ চলছে। নতুন করে আর কারো অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে বিকাল ৪টায় হাসপাতালে অসুস্থ লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সিইউএফএলের খুব কাছেই ডিএপি কারখানাটি। ডিএপি-১ সার কারখানার প্রধান গেটের পাশে ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যামোনিয়াম স্টোরেজ ট্যাংকে লিকেজের এ ঘটনা ঘটেছে। কারখানায় কাছাকাছি তিনটি ট্যাংকের একটিতে ছিদ্র হলেও বাকি দুটি ঠিক আছে।
দুর্ঘটনার পর রাত সাড়ে ১১টায় প্রথম হঠাৎ ঝাঁঝালো গ্যাসে আক্রান্ত হন। এ সময় অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে কাফকোর কর্মী ও এলাকার লোকজন অসুস্থ নিরাপত্তারক্ষীদের উদ্ধার করে কাফকো কলোনির চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ঘটনার পরপরই কাফকো ও সিইউএফএলের বিশেষ টিম উদ্ধার অভিযানে নামে। পরে পটিয়া থেকে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম এসে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। অসুস্থদের মধ্যে প্রায় ১২০ জন আনসার সদস্য ও বাকিরা পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা। এদিকে অগ্নিনির্বাপনে দলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আহত হন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক জসিমউদ্দিন মজুমদার ও নন্দনকানন ফায়ার স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আলী আকবর।
কাফকো মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা নেয়া মোহাম্মদ জয়নাল (৩৫) বলেন, হঠাৎ নাকে গন্ধ আসার পর বমি আসতে থাকে। তারপর মাথা ঘুরে পড়ে যাই। মাটিতে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর আর শ্বাস নিতে পারছিলাম না। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। শাহজাহান নামের অপর এক ব্যক্তি বলেন, অসুস্থ হওয়ার খবর জানার পরপরই মাইকিং শুরু করে প্রশাসন। এরপর বৈরাগ, বন্দর, রাঙ্গাদিয়া, গোবাদিয়াসহ আশপাশের গ্রামের মসজিদ থেকে লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পথে রাস্তায় অনেকে মাথা ঘুরে পড়ে যান।