মৃত্যুদণ্ডই বহাল রইলো মীর কাসেম আলীর। মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে তার করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গতকাল সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত ৫ বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর চার সদস্য হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। রিভিউ খারিজ হওয়ায় ফাঁসি কার্যকর থেকে মাত্র একধাপ দূরে আছেন মীর কাসেম আলী। প্রাণদণ্ড মার্জনার জন্য শেষ সুযোগ হিসেবে প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করতে পারবেন তিনি। যদি তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে দণ্ড মার্জনার আবেদন না করেন কিংবা আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায় তাহলে সরকার চাইলে যেকোনো সময় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মীর কাসেম আলী হলেন ষষ্ঠ ব্যক্তি যার রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। একই সঙ্গে জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা হিসেবে তার রিভিউ আবেদন গতকাল খারিজ হলো। এর আগে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হলে বিভিন্ন সময়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সরকার। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তার দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ আবেদন করেছেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষও তার সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে রিভিউ আবেদন করেছে। এটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে গতকাল ঘোষিত রায়ে সন্তোষ ও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ, আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, গণজাগরণ মঞ্চ, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীসহ মুক্তিযোদ্ধারা। অন্যদিকে রায়ের প্রতিবাদে আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। দণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেমের আইনজীবীরা জানান, মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে এ রায় হলেও সর্বোচ্চ আদালতের রায় তারা মেনে নিয়েছেন।
মীর কাসেম আলীর রিভিউর রায়কে কেন্দ্র করে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট ও তার আশপাশ এলাকায় নেয়া হয় কয়েকস্তরের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, র্যাবের সদস্যরা পুরো সুপ্রিম কোর্ট এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলেন। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও আদালত এলাকায় অবস্থান নেন। গতকাল সকাল থেকেই রায় শোনার জন্য মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা আদালত প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশে এসে জড়ো হন। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা ২ মিনিট। আদালতে তখন পিনপতন নীরবতা। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতি এজলাসে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। একটু পরই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিভিউর রায় খারিজ সংক্রান্ত আদেশ ঘোষণা করেন। বিকালেই ৫ বিচারপতির স্বাক্ষরের পর রায় প্রকাশিত হয়। পরে রায় পাঠিয়ে দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালে।
স্বস্তি ও সন্তোষ রাষ্ট্রপক্ষের: রিভিউর রায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় স্বস্তি ও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমিও আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি। আজ আমাদের স্বস্তির দিন। একাত্তরের ঘাতকদের শেষ পর্যন্ত বিচার করে তার অনেকগুলো কার্যকর করতে পেরেছি। একই প্রসঙ্গে স্বস্তি প্রকাশের পাশাপাশি উদ্বেগের অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সমগ্র জাতি যে আশা নিয়ে ছিল এবং আমিও ছিলাম, আজ তা পূর্ণ হয়েছে। এই রায়ে আমি সন্তুষ্ট। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর মীর কাসেমের কাছে জানতে চাওয়া হবে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না? তিনি যদি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন, তাহলে সেটি ভিন্ন কথা। না হলে সরকার যখন চাইবে রায় কার্যকর করা হবে। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল হানিফ বলেন, জনগণ যেরকম রায় আশা করেছিল, সেটি হয়েছে। এই রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আমরা, খুশি জাতিও খুশি। আশা করি, রায় দ্রুত কার্যকর করা হবে। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেন, এটি প্রত্যাশিত রায়। এই রায় নিয়ে আমাদের উদ্বেগ ছিল। এ নিয়ে বহু কথা হয়েছে। বহু রঙ ছড়ানো হয়েছে। তবে, আমাদের যেটি প্রত্যাশা ছিল সেটিই হয়েছে। তিনি বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত রায় হয়েছে। আমরা খুবই খুশি। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। সত্য সূর্যের মতো ধ্রুব। তিনি বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল। এই মামলার ধরনটাও একটু ভিন্ন ছিল। মীর কাসেম আলীকে বলা হতো জামায়াতের ‘খাজাঞ্চি’। সবদিক মিলিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। এই রায়ে আমাদের উদ্বেগের অবসান হয়েছে। এটি জাতি ও আমাদের জন্য এটি অসাধারণ মুহূর্ত। এই মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের বিষয়ে আপিল বিভাগের উষ্মা প্রকাশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তুরিন আফরোজ বলেন, আদালত আমাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেটি আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমরা যদি অযোগ্যই হতাম, তাহলে সর্বোচ্চ আদালত থেকে এ রায় আসতো না। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, মীর কাসেমের মামলায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক কথাই হয়েছে। বিষয়টি অতি কথনে দুষ্ট হয়েছে। অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। এটি দুঃখজনক। তারা কাজটি সঠিক করেননি। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। সার্বিকভাবে আমরা সফল হয়েছি।
বর্তমান প্রজন্ম ও ইতিহাস বিবেচনা করবে: খন্দকার মাহবুব
মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ ও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার প্রতিক্রিয়ায় তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মিথ্যা অভিযোগ ও মিথ্যা সাক্ষ্যে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, ইতিহাস ও আইন অঙ্গনে যারা আছেন তারা এই রায় বিবেচনা করবেন। তবে, তিনি উল্লেখ করেন, আপিল বিভাগ সাজা দিয়েছেন। তাই এই রায় সঠিক হয়নি, তা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ আদালত যেটি করেন, সেটিই ন্যায়বিচার। মীর কাসেম আলী প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি একজন আইনজীবী। এই মামলায় আইনি লড়াই করেছি। তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না-তার উত্তর অন্যত্র থেকে আপনারা (সাংবাদিকরা) জেনে আসুন। মীর কাসেমের রিভিউ আবেদনের রায়ের আগে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে ফাঁসির দড়ি প্রদর্শন ও রায়ের পর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণের সমালোচনা করে জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী বলেন, আজ এখানে ফাঁসির দড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। এটা অপমানজনক কিনা? এটা দুঃখজনক।
রায় শুনে বিচলিত মীর কাসেম: গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি মীর কাসেম আলী তার রিভিউ আবেদন খারিজ ও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার খবর রেডিওতে শুনেছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ। কাশিমপুর কারাগার-২ এর জেলার মো. নাসির আহমেদ গতকাল গণমাধ্যমকে জানান, কারাগারে বন্দিরা চাইলে এক ব?্যান্ডের রেডিও রাখতে পারেন। সেই রেডিওতেই মীর কাসেম আলী সকালে রায়ের খবর জেনেছেন। তিনি বলেন, আগে তাকে বেশ শক্ত দেখা গেলেও রায় শোনার পর অনেকটা নার্ভাস মনে হয়েছে তাকে। তিনি আরো জানান, রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী তারা আসামিকে তা পড়ে শোনাবেন। একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা-তা জানতে চাওয়া হবে। যদি তিনি মার্সি পিটিশন করতে রাজি হন তার জন্য তিনি সময় পাবেন। আর না করলে ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা করা হবে। দিনক্ষণ ও স্থান সরকার ঠিক করে দেবে। গত ৮ই মার্চ আপিলের রায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা এবং ৬ই জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ২০শে জুন তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। পরে ২৬শে জুলাই আবারও তাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
জামায়াতের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আজ: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার প্রতিবাদে আজ (বুধবার) সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা এই হরতাল কর্মসূচি চলবে বলে গতকাল দলটির এক বিবৃতিতে জানানো হয়। দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সদস্য এম আলম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে আরো জানানো হয়, অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, ফায়ার সার্ভিস, হজযাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ি ও সংবাদপত্রের গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।