ভূমিতে স্থানীয় বাহিনীর অভিযান, আর আকাশ থেকে আইএসবিরোধী বিদেশি শক্তির বিমান হামলায় এখন পর্যুদস্ত অবস্থায় আইএস। অব্যাহত হামলায় বর্তমানে তারা সিরিয়া ও ইরাকে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইএস ঘোষিত তথাকথিত খিলাফত হারানোর কথাও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে তারা। তবে হাল ছাড়েনি জঙ্গিরা। নতুন প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জঙ্গি সংগঠনটির সিনিয়র নেতাদের দৃষ্টি এখন ইউরোপে। আইএস-ফেরত বিদেশি যোদ্ধারাই জানিয়েছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
আইএসের দুটি শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ইরাকের মসুল আর সিরিয়ার রাকায় প্রচ- আক্রমণের শিকার হচ্ছে জঙ্গিবাহিনী। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের প্রকৃতি অপরিবর্তিত থাকলে শহর দুটির দখল খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না তারা। আর এ কারণেই ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলার দিকে ঝুঁকছে তারা।
সম্প্রতি আইএস ছেড়ে তুরস্কে পালিয়ে আসেন দুই বেলজিয়ান সহচর। তাদের নাম রশিদ ও ইয়াসিন। ২৭ বছর বয়সী রশিদ সিরিয়ায় যাওয়ার আগে একজন মেকানিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আইএস ইরাকের নির্দিষ্ট ভূমির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে ইরাকি সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত অনেক সামরিক ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান হামভিও দখল করে নেয়। একে অনেক বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছিলাম আমরা। হামভি দিয়ে খুব দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমেরিকার বিমান হামলার পর সব হিসাব-নিকাশ ভেস্তে যায়। তাদের হামলায় আমাদের অনেক সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়ে গেছে।’
রশিদ বলেন, ‘আইএস এখন নতুন ভূমির দখল নেয়ার চেয়ে দখলকৃত ভূমির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই লড়াইয়ের অনেকগুলো মাত্রা রয়েছে। আইএসের হাতে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অনেক মিসাইল আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। তবে এতে খুব কমই সাফল্য পেয়েছি আমরা। কারণ, আধুনিক বিমান ভূপাতিত করার মতো শক্তিশালী নয় সেগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইএস জঙ্গিরা এখনো খুব শক্তিশালী বোমা ও আত্মঘাতী গাড়িবোমা তৈরি করে যাচ্ছে। কারণ, তারা জানে, এই অস্ত্র দিয়ে শত্রুপক্ষকে ভয় দেখানো সম্ভব। কিন্তু আমেরিকা ও রাশিয়া যখন বিমান হামলা শুরু করে, তখন শত্রুদের ধ্বংস করার আগেই এসব গাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তাই আইএসের এই কৌশল বিকল হয়ে পড়ে। আর দিনের পর দিন আত্মঘাতী হামলাকারীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।’
রশিদের মতে, দ্বিধাবিভক্ত আইএস নেতারা নিজেদের লক্ষ্য ও করণীয় সম্পর্কে গোপন আলোচনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতেই ইউরোপে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। আর এ উদ্দেশ্যে আত্মঘাতী হামলাকারীও প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইউরোপে সম্ভাব্য হামলাকারী অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বিস্ফোরক বহন করবে, যেন কম লোকবলে বেশি ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো সম্ভব হয়। বেশিরভাগ আইএস যোদ্ধারাই মনে করে, মসুল ও রাকা দখল করে রাখা সম্ভব নয়। তাই এই লড়াই ইউরোপের দিকে সরিয়ে নেয়াই উচিত।
এদিকে, লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত শীর্ষ কমান্ডারদের হারিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে আইএসের। আবার বাহিনীর ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতার কারণেও অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, ভূমি হারিয়ে যার মাসুল দিচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠীটি। একই সঙ্গে আমেরিকা ও রাশিয়ার বিমান হামলায় আগে দখলকৃত ভারী যুদ্ধ সরঞ্জাম ধ্বংস হওয়ার ফলে বর্তমানে হালকা অস্ত্র, আত্মঘাতী গাড়িবোমা এবং বিস্ফোরকদ্রব্যের ওপরই নির্ভরশীল করে তুলছে তাদের।
তবে কবে কখন বা কীভাবে এসব জঙ্গি হামলা পরিচালিত হতে পারে, সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি রশিদ ও ইয়াসিন। তাদের দাবি, এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানেন না তারা। ইয়াসিন বলেন, ‘সম্ভাব্য হামলা নিয়ে গোপন সভা করেছেন আইএসের শীর্ষ নেতারা। তাদের বিস্তারিত আলাপের সময় আমরা ওই কক্ষে ছিলাম না। তবে আইএসপ্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারীদের মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ইউরোপে বেলজিয়ামকে জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ও বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে হামলার জন্য সিরিয়া থেকে ফিরে আসা আইএস জঙ্গিরা কাজ করে যাচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে ব্যাপক রক্তপাতের শিকার হতে পারে ইউরোপ।