নোট বাতিলে সাধারণ মানুষের যে দুর্ভোগ হচ্ছে তা নিয়ে প্রথম থেকেই সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে গিয়ে প্রতিবাদে শামিল করেছেন সব বিরোধী দলকে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একের পর এক তীব্র সমালোচনার বাণ ছুড়ছেন তিনি। আর নোট বাতিল নিয়ে সোচ্চার এই প্রতিবাদের জন্যই মোদি সরকার মমতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যকে না জানিয়ে বিভিন্ন জেলায় হাইওয়ে ও টোল প্লাজাগুলোতে সেনা নিয়োগেও চক্রান্ত দেখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার পাটনা থেকে মমতার ফেরার পথে বিমানে জ্বালানি শেষ হয়ে আসছে জানানোর পরও দমদম বিমানবন্দরে বিমান নামতে দেরি করানোর পেছনে চক্রান্ত রয়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। আর এর পরেই রাজ্যের ১৮টি জেলায় সেনা নামানোর প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সচিবালয় নবান্নে ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন। শেষমেশ ৩০ ঘণ্টারও পর নবান্ন ছাড়েন মমতা। আর নবান্ন ছাড়ার আগে আরও একবার হুঁশিয়ারি দেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র আমাদের শাসানোর চেষ্টা করছে। আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে লড়বো।’ শুক্রবার রাজ্যের মন্ত্রী ও বিধায়করাও সম্মিলিতভাবে রাজভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। দাবি করেছেন সেনা প্রত্যাহারের। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, কেরল, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। কোথাও সেনা নামানো হয়নি। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে। কেন? মানুষের কথা বলছি বলে? তার অভিযোগ, রাজনৈতিক স্বার্থেই সেনাকে ব্যবহার করছে কেন্দ্র। কলকাতায় তৃণমূল নেত্রীর এই অগ্নিমূর্তি শুক্রবার সকাল থেকেই সরগরম হয়ে উঠেছিল দিল্লিও। সংসদে বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে। সেনা ইস্যুতে তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে লোকসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসর মল্লিকার্জুন খার্গে বলেছেন, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেনা নামানো দুর্ভাগ্যজনক। কেন কেন্দ্র এমন কাজ করছে? তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বিএসপির মায়াবতীও মমতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজ্য সরকারের অনুমতি ছাড়া সেনা মোতায়েন করা যায় না। লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সেনাবাহিনী কী বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। তারা বলছে, রুটিন মহড়া চলছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য নাকি এটা মহড়া। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে পড়ে না। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সংসদে অভিযোগ করেছেন, সেনাবাহিনী পশ্চিমবঙ্গে মহড়ার জন্য রাজ্য সরকারের অনুমতি নেয়নি। রাজ্যকে না জানিয়ে যেভাবে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত বলে অভিযোগ করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে কেন নামানো হল সেনা? রাজ্যে কি সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছে? বৃহস্পতিবার রাতে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেনা বিতর্ক ও মমতার বিমান বিভ্রাট নিয়ে গত দুদিন ধরে সংসদের দুই কক্ষ উত্তাল হয়ে উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিবাদ বিক্ষোভের জেরে। সেনা বিতর্ক ও বিমান বিভ্রাট নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে নালিশ জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেনাবাহিনী অবশ্য আগাম অনুমতি নিয়েছিল বলে দাবি করেছে। শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনীর বেঙ্গল এরিয়া সদর দপ্তরের তরফ থেকে সাংবাদিক বৈঠকে জানানো হয়েছে, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে মালবাহী গাড়ির প্রয়োজন হলে খুব দ্রুত কত গাড়ি জোগাড় করা সম্ভব, সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে সেই সমীক্ষাই চালাচ্ছে। এটি সেনার বার্ষিক মহড়ার অঙ্গ এবং রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই এই মহড়ার দিন স্থির করা হয়েছে। শুক্রবারই তা শেষ হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও জানিয়েছেন, এটি রুটিন মহড়া। মুখ্যমন্ত্রীর আচরণকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি। বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং তীব্র কটাক্ষ করে বলেছেন, নোট বাতিলের পর মমতার মানসিক অবস্থা খারাপ। তাই সবকিছুতেই তিনি ষড়যন্ত্র দেখছেন। তার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। সেনাবাহিনীর দাবি অবশ্য উড়িয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী এ বিষয়ে রাজ্য সরকারকে কিছুই জানায়নি। মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিজি, পুলিশ কমিশনার, সকলে সেনাবাহিনীর দাবি খারিজ করেছেন। এদিকে বুধবার রাতে পাটনা থেকে ফেরার পথে জ্বালানি ফুরিয়ে আসার বিষয়টি নিয়ে খতিয়ে দেখতে তদন্তে নেমেছে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)। শুক্রবার সকালেই কলকাতা বিমানবন্দরে বুধবার সন্ধেয় কর্তব্যরত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) অফিসারকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর উত্তাল ছিল সংসদের দুই কক্ষ। এ ছাড়া কলকাতায় নামার লাইনে ইন্ডিগো-র আগেই যে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছিল, সেই পাইলটকেও ডেকে পাঠানো হতে পারে। বুধবার সন্ধ্যায় এটিসি-র সঙ্গে ইন্ডিগোর পাইলটের কথাবার্তার টেপ, ইন্ডিগোর বিমানের ককপিট ডেটা রেকর্ডার চেয়ে পাঠানো হয়েছিল দিল্লি থেকে। এটিসি-র টেপ বৃহস্পতিবারেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে দিল্লিতে। তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, কলকাতার আকাশে এসে জ্বালানি ফুরিয়ে এসেছিল ইন্ডিগোর বিমানের। যা থেকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। বিমানটি ভেঙে যেতে পারত। এর পিছনে চক্রান্ত রয়েছে বলেও দাবি করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলের সাংসদ এবং সংসদের পরিবহনবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মুকুল রায় এ নিয়ে বিমানমন্ত্রী অশোক গজপতি রাজুকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করার আবেদনও জানিয়েছেন তিনি। কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খার্গে বলেছেন, তিনটি বিমানের জ্বালানি কম থাকলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিমানে ছিলেন, সেটিকে জরুরি অবতরণ করানো দরকার ছিল। কারণ, ভিভিআইপি থাকলে সেটিকে অগ্রাধিকার দেয়াই নিয়ম।