নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক দুজন কাউন্সিলর নুর হোসেন ও নজরুল ইসলামের বিরোধ ও দ্বন্দ্বেই সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এখানে ‘সুশৃঙ্খল’ বাহিনী র্যাবের উচ্চাভিলাষী কয়েকজন লোকের সঙ্গে মিশে ঘৃণ্যভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। এখানে শুধু নজরুল একক টার্গেট থাকলেও প্রাণ হারাতে হয়েছে নিরীহ ৬ জনকে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকর্তাদের নিয়োগে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডার মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এসব কথা বলেছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সংবাদ সম্মেলন কক্ষে রোববার বেলা ১১টায় সেভেন মার্ডার মামলার রায় ঘোষণার ৬ দিনের মাথায় প্রেস ব্রিফিংয়ে আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
গত ১৬ই জানুয়ারি সাত খুন মামলার রায় দেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। রায়ে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ও নুর হোসেনসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী এবং রাজনৈতিক তথা সন্ত্রাসীদের কাজ এটি। এখানে একজন নুর হোসেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ভূমিদুস্য। অপরজন (নজরুল) সন্ত্রাসী পরিচিতি লাভ করেছেন। সিটি করপোরেশনের সাবেক দুই কাউন্সিলর নুর হোসেন ও নজরুল ইসলামের বিরোধ ও দ্বন্দ্বেই সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে। দুজনেই সন্ত্রাসী ছিলেন, দুজনের ছিল বিশাল বাহিনী। দুজনেই এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। নুর হোসেনের প্রধান টার্গেট ছিল নজরুল। কিন্তু এখানে একজন তথা নজরুলকে হত্যা করতে গিয়ে নুর হোসেন বাহিনী ও র্যাব সদস্যদের দ্বারা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে নিরীহ ৬ জনকে।’
আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, র?্যাব একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এ বাহিনীর অনেক সুনাম ও সুখ্যাতি আছে। সন্ত্রাসবিরোধী থেকে আরম্ভ করে জঙ্গি দমন, মাদক নির্মূলসহ বিভিন্ন অর্জন রয়েছে এই বাহিনীর। কিন্তু এদের যে কয়েকজন ব্যক্তি এই ঘটনার জন্য জনসাধারণের সঙ্গে মিশে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এর সমস্ত দায়দায়িত্ব তাদের। তারা উচ্চাভিলাষী জায়গা থেকে ঘৃণ্যতম অপরাধটি সংঘটিত করেছেন। তাদের দ্বারা র?্যাবের মান-সম্মান ক্ষুণ্ন হলেও সার্বিকভাবে র?্যাব বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়নি। র?্যাব জাতির একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী, তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে র?্যাবকে প্রশংসাও করেছেন। আবার তিরস্কার দিয়েছেন। যাতে করে ভবিষ্যতে র?্যাব বাহিনীতে এই ধরনের উচ্চাভিলাষী, ঘৃণ্যতম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, এমন ব্যক্তিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। তাছাড়া যারা আছেন তারাও যেন সতর্ক হয়ে যান।
পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, তারা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময় যেসব অভিযোগ এনেছিলেন, সেই অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করেছে। যারা এই হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, সেই ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। আর ৯ জনের মধ্যে যে ৭ জন অপহরণের সঙ্গে জড়িত, তাদের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন এবং ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন। দুজনকে আলামত নষ্ট ও ধ্বংস করার চেষ্টার অভিযোগে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান এবং ২৫ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করেছেন। এই রায়ের কপি উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরে ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে পর্যায়ক্রমে কার্যক্রম হবে। সেখানেও আসামিদের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকবে বলে ওয়াজেদ আলী খোকন প্রত্যাশা করেন।
পিপি জানান, ঘটনার দিন (২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল) অপহরণের পর র্যাব জানায় সেটা লিগ্যাল অর্ডার ছিল। কিন্তু আমরা রাষ্ট্রপক্ষ বলছি কাউকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করতে হবে। তাহলেই সেটা লিগ্যাল অর্ডার হবে। কিন্তু র্যাবের কতিপয় সদস্য ৭ জনকে অপহরণ ও হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে, লাশ গুম করেছে। এসব ঘটনায় ৩৫ জন ছিলেন। এরা অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাদের মধ্যে ২৬ জন সরাসরি হত্যা, ৭ জন অপহরণ ও অপর ২ জন আলামত নষ্ট করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, র?্যাবের যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের তিরস্কৃত করেছেন আদালত। ওই সব পদে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, সাত খুনের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্যানেল মেয়র নজররুল ইসলামসহ ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে একটি মামলা এবং নিহত আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় তার জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে অপর একটি মামলা দায়ের করেছেন। প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় সেলিনা ইসলাম বিউটির মামলায় শাস্তির ঘোষণা করেছেন আদালত। অপর নিহত আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার মামলায় একই সাজা ঘোষণা করেছেন আদালত।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, দুটি মামলার রায় হলেও আসামিরা সাজা ভোগ করবেন একসঙ্গে। একই দিন থেকে সাজার গণনা শুরু হবে। যারা পলাতক আছেন, গ্রেপ্তারের দিন থেকে অথবা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্থন করলে সেদিন থেকে তাদের সাজা গণনা শুরু হবে।
প্রেস ব্রিফিং শেষে সাত খুন মামলার রায়ের কপি, জুডিশিয়াল রেকর্ড, সিডিসহ বিভিন্ন নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ওয়াজেদ আলী খোকন।
মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে: এদিকে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার ডেথ রেফারেন্সের নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। রোববার নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এই নথি প্রেরণ করেন। দুপুর দেড়টায় দুটি মামলার রায় পৃথক লাল কাপড়ে মুড়িয়ে কড়া পুলিশ পাহারায় পাঠানো হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির মো. আবদুল বাতেন মোড়লের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি টিম রায়ের কপি হাইকোর্টে পৌঁছে দেন। ১৬৩ পাতা করে প্রতিটি মামলার রায়ে রয়েছে ১১ হাজার করে লাইন।
নিয়ম অনুযায়ী, বিচারিক আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদনের জন্য মামলার নথি হাইকোর্টে প্রেরণ করা হয়, যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত। এখন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এই সাজা অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে ‘ডেথ রেফারেন্স’ শুনানি হবে। সেখানে সাজা বহাল থাকলে তারা আপিল করতে পারবেন। আপিলের জন্য আসামিরা ৩০ দিন সময় পাবেন। যদি কেউ আপিল না করেন, তাহলে তার ক্ষেত্রে শুধু ডেথ রেফারেন্সেরই শুনানি হবে।