নতুন বোরো চালে বাজার ভরপুর। এ অবস্থায় চালের দাম কমার কথা। কিন্তু ক্রমেই বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ নিম্নবিত্তের ওপর। তবে হঠাৎ কেন চাল নিয়ে এই সংকট এ প্রশ্নের জবাব মিলছে না খুচরা চাল ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা বলছেন, মিল মালিকদের চালবাজিতেই বড় সংকট তৈরি হয়েছে। কারণ হঠাৎ করে এমন সংকট তৈরি হওয়ার কথা নয়। নানা অজুহাতে মজুত করা চাল বাজারে ছাড়ছেন না মিলাররা। ফলে দেশে চাল সংকটে পড়েছে। পাইকাররা বলছেন, মোকামে চালের সংকট। সরবরাহ কম। তাই বেড়েছে মোটা চালসহ সব ধরনের চালের দাম। রাজধানীর বৃহৎ চালের আড়ত বাবুবাজারসহ বেশ কয়েকটি চালের মার্কেট ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বড় মিল মালিকদের কারসাজিতে বাজারে দুই মাস ধরে বাড়ছে চালের দাম। দুই মাসে শুধু মোটা চালের দাম কেজিতে ১২ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে চালের খুব বেশি সংকট না থাকলেও আমদানি শুল্ক বেশি থাকা ও হাওরাঞ্চলের ফসলহানির অজুহাতে চালের দাম বাড়াচ্ছে মিল মালিকরা। চাল আমদানি না হলে চালের দাম আগামী কয়েক মাসে আরো বাড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, চাহিদা ও যোগানে ভারসাম্য না থাকলে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়ে। এখন চালের যে চাহিদা আছে সেই তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় চালের দাম বাড়তি। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
সূত্র জানায়, সরকার জি টু জি ভিত্তিতে ভিয়েতনাম থেকে যে চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সেই চাল দেশের বাজারে পৌঁছালেই দাম কমবে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে আরো আড়াই লাখ টন চাল আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ভিয়েতনাম থেকে প্রতিটন চাল আমদানি করা হবে ৪৭০ ডলারে। প্রতিকেজি চালের দাম পড়বে ৩৭.৬০ টাকা। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত সরকারি গুদামে মজুত ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার টন চাল। যা গত ৬/৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ধান ও চালের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার ৭ লাখ টন ধান কিনবে সরকার। প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। অন্যদিকে ৮ লাখ টন চাল কেনা হবে সরকারিভাবে। এ জন্য প্রতি কেজি চালের দাম ৩৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২২ ও চালে ৩১ টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদন খরচ মাথায় রেখেই সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তারা। তাদের মতে, এক মণ ধানে চাল হয় ২৬ কেজির বেশি। আর অটোমেটিক মেশিনে হয় ৩০ কেজির কাছাকাছি। এই হিসেবে ৩১ টাকা ক্রয়মূল্য ধরা হলে এক বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম আসে ১৫৫০ টাকা। আর সরকার নির্ধারিত মূল্য ধরা হলে দাম আসে ১৭০০ টাকা। সে হিসাবে প্রতিকেজি চালের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা যাওয়ার কোনো কারণ নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে মোটা চালের প্রতি কেজি চালের দাম ৩১ থেকে ৩৭ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে তা গড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত।
চালের দাম বৃদ্ধির কারণের সূত্রগুলো জানায়, কৃষকের ঘর থেকে ধান চলে যাওয়ার পর ফড়িয়াদের মাধ্যমে সেগুলো যায় মিল মালিকদের হাতে। মিল মালিকরা সেগুলো গুদামজাত করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এতে ধানের দাম বেড়ে যায়। আর ধানের দাম বাড়ানোর পর তারা চালের দামও বাড়ায়। মিল পর্যায়ে দাম বাড়ার পর পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে আসতে যত হাত বদল হয় ততবার দাম বাড়ে। মূলত এভাবেই চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, মিলাররা ধান সরবরাহে সংকট দেখিয়ে চালের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। মিলাররা প্রতি বস্তা চালে মিলগেটেই ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আগের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করছেন। কারসাজি করে এভাবে বেশি দাম নেয়ায় ঢাকার পাইকারি বাজারগুলোয় চাল আসা একেবারেই কমে গেছে। নতুন করে তারা চাল তুলতে চাইছেন না। এখন যে ধান রয়েছে তার সবই মিলারদের হাতে। এ সুযোগে তারা তাদের ইচ্ছামতো চালের দাম নির্ধারণ করছেন। ফলে বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে।
রাজধানীর আড়তদাররা জানান, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হলেও এর সঙ্গে পরিবহন খরচ, মজুর, সংরক্ষণ ও স্থানীয় পরিবহন খরচের কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে আরো ৪-৫ টাকা। পাবনা থেকে ১৫ টন বা ৫০ কেজি ওজনের ৩০০ বস্তা চাল ঢাকায় আনতে ট্রাক ভাড়া পড়ছে ১৫ হাজার টাকা। এতে কেজিপ্রতি পরিবহন খরচ পড়ছে ১ টাকা। মজুর, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন ও অন্য খরচের সঙ্গে রাজধানীর ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করলে প্রতি কেজি চালের দাম দাঁড়ায় ৫৫ টাকা। পাইকারি ও খুচরা বাজারে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে নিম্নমানের নাজিরশাইল চালের বস্তা ২৪৫০ টাকার বদলে ২৫৫০ টাকা হয়েছে। আর খুচরা বাজারে ৫০ টাকার নিম্নমানের নাজিরশাইল ৫৩ টাকা হয়েছে। এছাড়া খুচরা বাজারে স্বর্ণা চাল ৪৫-৪৮ টাকা, উন্নতমানের মিনিকেট ভালো ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ধান এখন কয়েকজন অটো মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারা ইচ্ছামতো দামে চাল বাজারে ছাড়ছেন। বাজার ওঠানামা মূলত অটো মিলারদের ওপর নির্ভর করছে। উচ্চ শুল্কায়নের কারণে বর্তমানে ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ রয়েছে।
বাবুবাজারের এবি রাইস এজেন্সির ম্যানেজার ডালিমসহ একাধিক চাল আড়তদার বলেন, চালের ব্যবসা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যেকোনো সময় দোকানের শাটার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, বড় বড় মিল মালিকরা চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। যার প্রভাব পড়ে বাজারে। সামনের মৌসুমের ধান বাজারে না আসা পর্যন্ত চালের দাম কমারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন বলেন, আমরা চাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক প্রত্যাহার করে আমদানির সুযোগ দিতে সরকারের কাছে দাবি করছি। হাওরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে চাল আমদানির কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল এনে বিক্রি করি। মাঝখানে সামান্য কিছু মুনাফা করি। মিল মালিকরা দাম বাড়ালে আমরা বৃদ্ধি করি। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে হাওরে অকাল বন্যায় ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। এছাড়া সরকারের গুদামে চালের মজুত সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে। ফলে ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ নিচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।