শূন্যতা, একবুক যন্ত্রণা আর চোখের জল তাদের পরিবারের সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে আছে। ৬ বছরের ছোট্ট শিশুর অবুঝ ভাবনা, তার বাবা তারার দেশে চলে গেছে। ১১ মাসের দুধের শিশুটি পৃথিবীতে আসার আগেই বাবা চলে গেছে না ফেরার দেশে। ভালোবাসার সঙ্গী স্ত্রীও হয়েছেন নিঃসঙ্গ। আর ছেলেহারা মায়ের অবুঝ কান্না থামেনি আজও। এমন চিত্র একবছর আগে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামের বাড়িতে।
গুলশান ট্র্যাজেডির এক বছর আজ। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম এলাকার মানুষের ভালোবাসার মানুষ ছিলেন রবিউল ইসলাম। শুক্রবার সকালে এসি রবিউলের বাড়িতে দেখা গেল পরিবারের শূন্যতা আর একবুক যন্ত্রণার দৃশ্য।
অর্থনৈতিক দৈন্যতার কথা না জানালেও রবিউলের অভাব কুরে কুরে খাচ্ছে এ পরিবারটিকে। বাড়িতে প্রবেশ করেই প্রথমে কথা হয় রবিউলের ৬ বছরের ছেলে সামির সঙ্গে। তার বাবার কথা জানতে চাইলেই সে ছোট্ট করে উত্তর দেয় বাবা তারার দেশে চলে গেছে। ঈদে বাবা আসেনি। চাচ্চুর সঙ্গে ঘুরেছি। অবুঝ শিশুর বাবার প্রতি এই ভালোবাসা পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র এই পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি।
এরপরই ১১ মাসের শিশুকন্যা কামরুন্নাহার রাইনাকে কোলে নিয়ে আসেন রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমা। তার চোখটা তখন ছলছল করছিল। কেমন আছেন জানতে চাইলে একবুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- ভালো আছি।
উম্মে সালমা বলেন, রবিউলের অভাব মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকবে। সে শুধু আমার স্বামীই ছিল না, সে ছিল আমার বন্ধু, আমার অভিভাবক। সে আমার সব প্রবলেম সমাধান করতো এবং আমার জীবনের সবকিছুই আমি তার সঙ্গে শেয়ার করতাম। ওকে ছাড়া আজ আমি বড়ই একা। আজ সংসারের সবকিছু আমার নিজেকে করতে হয়। দুঃখ আছে কষ্ট নেই। তার কারণ আমি একজন শহীদের স্ত্রী। সবাই আমাকে শহীদের স্ত্রী হিসেবে যথাযথ সম্মান দেয়।
কিন্তু আমার অবুঝ দুই সন্তানের দিকে চেয়ে কষ্ট হয়। আমি যতই ওদের আদর সোহাগ করি না কেন, ওরা তো সারা জীবন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। একথা বলতেই উম্মে সালমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছু সময় তার কণ্ঠরোধ হয়ে পড়ে। সান্ত্বনা জানানোর ভাষা নেই কারো।
কান্না জড়িত কণ্ঠে উম্মে সালমা বলেন, আমার বর্তমানে ১১ মাসের কন্যা সন্তানের জন্মের একমাস আগেই ওর বাবা চলে যায়। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল একটা কন্যা সন্তানের। কন্যা সন্তান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জেনে যাওয়ার ভাগ্য হয়নি তার।
আমার এ ছোট্ট মেয়ে যখন বড় হয়ে জানতে পারবে তার জন্মের একমাস আগে ওর বাবা চলে গেছে, তখন তার কি প্রতিক্রিয়া হবে আমার জানা নেই।
রবিউলের স্ত্রী বলেন, আমার ৬ বছরের ছেলে সামি যখন একটু বুঝতে শিখছে তখন ওর বাবা চলে গেল। সে ওর বাবাকে খুব মিস করছে। বিশেষ করে রাতে। ওর বাবা বাসায় না ফেরা পর্যন্ত সে জেগে থাকতো। বাড়িতে এসে ছেলের সঙ্গে দুষ্টুমি করার পরই সে ঘুমাতো। এছাড়া ঈদে বাবার সঙ্গে নামাজ পড়তে যেত। কিন্তু এখন যখন দেখে অন্য ছেলেরা তার বাবার সঙ্গে হাসি আনন্দ করে, তখন যে ওর খুব কষ্ট হয় তা আমি বুঝতে পারি। সে তখন অন্যরকম আচরণ করে। বাবার অভাব ওদের আমি কিভাবে পূরণ করবো। তারপরও ওদের সবসময়ই হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করি।
সন্তান ডাক্তার হবে সে ইচ্ছা রবিউলের কখনোই ছিল না। সে সবসময় চাইতেন তার সন্তান সঠিক পথে থেকে সৎ এবং প্রকৃত মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। আমিও চাই ওরা বাবার আদর্শে মানুষ হবে এবং সেভাবেই গড়ে উঠবে।
উম্মে সালমা বলেন, সরকার আমার পরিবারকে আর্থিকভাবে যে সহায়তা করেছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তাদের দেয়া অনুদান থেকেই আমার সংসার চলছে।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যোগ্যতাভিত্তিক চাকরির আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা হয়নি। তবে আমি আশা রাখবো ইনশআল্লাহ হয়ে যাবে। সালমা বলেন, চাকরিটা তাড়াতাড়ি হলে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে পারবো এবং কাজের মধ্যে থাকলে মানসিকভাবে কিছুটা শান্তি পাবো।
উম্মে সালমার পাশে বসে অঝরে কাঁদছিলেন রবিউলের মা করিমুন নেছা। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ছেলে হারানোর শোক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কী ভুলতে পারবো। তারপরও সবাই যখন আমাকে শহীদের মা বলে ডাকেন তখন শত কষ্টের মাঝেও আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আমার দুই সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। রবিউল তার প্রমাণ দিয়ে গেছে দেশ বিদেশের কাছে। সে সব সময়ই গরিব দুঃখী মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে ভালোবাসতো। তার স্বপ্ন ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। সেটাও করে গেছে। দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণার মাঝেও আমি একজন শহীদের মা হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই। ’৭১ সালের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের যেমন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং লিখিত সার্টিফিকেট দেয়া হয়, আমি সরকারের কাছে প্রত্যাশা করি আমাকে প্রকৃত শহীদের মায়ের স্বীকৃতি যেন সেভাবেই দেয়া হয়। সেটা করা হলে আমি মরেও শান্তি পাবো। ভবিষ্যতে আমার নাতি, নাতনি, বৌমা উপকৃত হবে।
রবিউলের একমাত্র ছোট ভাই শামসুজ্জামান সামস বলেন, আমার ভাই ছিলেন একজন সাংস্কৃতিমনা মানুষ। বাংলা সংস্কৃতিকে ধারণ করার প্রচষ্টা তার মধ্যে সবসময়ই আমরা দেখেছি। আমার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল প্রতিবন্ধীদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। সেই স্বপ্ন আমার ভাই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। আরো স্বপ্ন ছিল অসচ্ছল বৃদ্ধদের জন্য বৃদ্ধনিবাস গড়ে তোলা। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নের আগেই ঘাতকরা আমার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে।
সামস বলেন, স্কুলের সব খরচ আমার ভাই ও তার বন্ধুরা মিলে চালাতো। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য বন্ধুদের পাশাপাশি স্কুল পরিচালনায় যুক্ত হয়েছেন দেশের সবাই। যার যার অবস্থান থেকে তারা স্কুলের জন্য সাহায্য সহযোগিতা করে চলেছেন। আমাদের একার পক্ষে স্কুল পরিচালনা করা সম্ভব না। তাই সরকার যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তবেই ভাইয়ের এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন সহজ হবে। সব শেষে একজন শহীদের ভাই হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।
রবিউলের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অফ ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি- বুমসসের পরিচালক (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ স্কুলটি ছিল রবিউলের স্বপ্ন। ২০১১ সালে রবিউল প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন এখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪১ জন। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে রবিউল ইউনিফর্ম, টিফিন খাদ্য, বই, স্টেশনারি এবং সরঞ্জাম এবং স্কুল-ভ্যানসহ শিক্ষার্থীদের সব খরচ বহন করতেন। আজ বরিউল নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতি আমরা অম্লান করে রাখবো সারা জীবন।
এদিকে শনিবার সকালে রবিউলের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করবে আট্রি গ্রামবাসী। জঙ্গিবিরোধী সমাবেশ, মানববন্ধন, রবিউলের কবরে ফুলেল শ্রদ্ধা এবং শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠিত হবে। পুলিশ প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এতে অংশ নেবেন।