ছেলেটির চোখে-মুখে খেলা করতো স্বপ্ন। গরিবি হটানোর লড়াই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। মাকে কথা দিয়েছিলেন, দুই বছর পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো এর আগেই এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে তার জীবনের সব স্বপ্ন। তছনছ হয় যাবে সবকিছু। অন্ধকার এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যাবেন তিনি।
সিদ্দিকুর রহমানের জীবনের গল্পটা বাংলাদেশের আর দশটা ছেলের মতোই। আবার ব্যতিক্রমও। গরিব এক পরিবারের ছেলে। খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারান। মা আর বড় ভাই টেনে নেন সংসারের হাল। দিনমজুর বড় ভাই নিজে কষ্ট করে পড়ালেখা করান সিদ্দিকুরকে। টিউশনি করে টেনেটুনে চলে যাচ্ছিল তার জীবন। পড়েন তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। আশা ছিল, পাস করেই যোগ দেবেন কোনো চাকরিতে। বিসিএসের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজে শিক্ষার শ্লথ গতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিদ্দিকুরের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনে। পরীক্ষার রুটিন চেয়েছিলেন তারা। এটাকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে দেয়া হয়েছে বাধা। নিক্ষেপ করা হয়েছে টিয়ারশেল। চোখঘাতী এক টিয়ারশেল কেড়ে নিয়েছে সিদ্দিকুর রহমানের চোখের আলো। এ নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা বিস্ময় আর হতবিহবল করে দিয়েছে কোটি হৃদয়কে। এমন ঘটনাও কারো জীবনে ঘটে। এতো অকস্মাৎ মানুষের জীবনের সবকিছু এমন ওলটপালট হয়ে যায়। এটা তো শুধু একজন ছাত্রের, একজন মানুষের চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। একটি পরিবার, একটি সংসার, একটি স্বপ্নেরও চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া। নাকি এ ঘটনা পুরো একটি জাতি যে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেদিকেও নির্দেশ করে।
গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। না, শিক্ষা-দীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ছিল না। গবেষণা, আবিষ্কারেও তেমন সুনাম নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু একটি জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা হয়ে গেছে দুনিয়ার আর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনেও রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগান্তকারী ভূমিকা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দাবি জানাতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী, একজন তরুণ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন নাগরিক তার চোখ হারিয়েছেন। দুঃখ এবং বেদনার সঙ্গে এটা দেখা যাচ্ছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে এ ঘটনার বিরুদ্ধে টু শব্দও হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মা কি তবে মরে যাচ্ছে? এ বিশ্ববিদ্যালয় কি তার অতীতের সব ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়?
পৃথিবীর ইতিহাসে নানারকম বাক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসও তাই। যদিও ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছিলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের হীরন্ময় দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী ও বর্বর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে তৈরি করেছিল ইতিহাসের মহা অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষা। যদিও ইতিহাসে নানারকম গোজামিল ছিল। এরপরও বাংলাদেশের মানুষ বারবার রাস্তায় নেমেছে। নানা ইস্যুতে। তবে তাদের স্বপ্ন চুরি হয়েছে বহুবার। রাজনীতিবিদরা ফল ভোগ করেছেন। যন্ত্রণায় পুড়েছেন মানুষ। সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাদের। এমনকি দিতে হয়েছে জীবনও।
এমন সব দিনের পর মানুষ হয়তো তার প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষাই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সিদ্দিকুরকে অন্ধ করে দেয়ার পেছনে কোনো হিসাবই মেলে না। সাধারণ একটা ছেলে। একেবারে সাধারণ। তার কোনো রাজনীতি ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দাবি নিয়ে রাষ্ট্রের সামনে হাজির হয়নি সে। সামান্য দাবি উত্থাপন করতে গিয়ে অসামান্য ক্ষতি হয়ে গেল তার। এ দায় আমরা কারা নেবো। সিদ্দিকুর রহমানের ভাইয়ের আহাজারি যে কারো মনেই ক্ষত সৃষ্টি করতে বাধ্য। রাষ্ট্রের হৃদয় আছে কিনা কে জানে? থাকলে রাষ্ট্রেরও তাতে ব্যথিত হওয়ার কথা। সিদ্দিকুরের ভাই নায়েব আলি বলছিলেন, ‘আমার সব স্বপ্ন শেষ হইয়া গেল। আমার ভাই আর চোখে দেখতে পারতেছে না। আমি এখন কি করমু। নিজে খাইয়া না খাইয়া ওর পড়ার খরচ চালাইতাম। সেই ভাইটার এই অবস্থা।’
সিদ্দিকুরের নির্মম পরিণতির বেদনাদগ্ধ প্রকাশ ঘটেছে আলী রীয়াজের লেখা কবিতায়। তিনি লিখেছেন-
আমাকে অন্ধ করে দাও
যেন না দেখতে পারি
ক্রুর হাসি, বিদ্রূপের কষাঘাত;
আমাকে অন্ধ করে দাও
যেন না দেখতে পারি
বিপর্যয়ের কালো থাবা,
অধিকার লুণ্ঠনের অট্টহাসি,
প্রতিহিংসার অন্তহীন আগুন,
আত্ম-অবমাননার মহোৎসব।
আমাকে দৃষ্টিহীন করো
যেন আমাকে না বইতে হয়
নির্মমতার স্মৃতি।
যেন আলোহীন আমি আর দেখতে না পাই
আলোর নিচেই কত অন্ধকার চারিদিকে;
যেন আমি আর রাজপথে না হই শামিল
মানবিক মর্যাদার স্বপ্ন এসে না ভীড় করে চোখের পাতায়।
আমার চোখগুলো উপড়ে ফেলো,
আমাকে অন্ধ করে দাও,
আমাকে অন্ধ করে দাও
যে রকম আমার বন্ধুকেই করেছো সেদিন।
না প্রভু, না ঈশ্বর, না তোমার কাছে নয়,
এ আমার প্রার্থনা
উদ্যত সঙ্গীনের কাছে,
যে আছে দণ্ডায়মান আমার সমুখে;
হে রাষ্ট্র, শক্তির আধার আমাকে অন্ধ করে দাও।