মোবাইল ফোনের অননেট ও অফনেট নিয়ে চলছে কারসাজি। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। কম খরচে সেবা দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করছেন বেশি টাকা। বেশি গ্রাহক রয়েছে এমন অপারেটররা বর্তমান কল রেটের সুবিধা পাচ্ছেন বেশি। অন্যদিকে কম সংখ্যক গ্রাহক নিয়ে যেসব অপারেটর আছেন তারা দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর টেলিটক সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অপারেটরদের এ অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন ১৩ কোটিরও বেশি গ্রাহক। বিষয়টি অনুধাবন করে নতুন কলরেটের একটি প্রস্তাব তৈরি করে বিটিআরসি। মূলত গ্রাহকবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতেই প্রতিষ্ঠানটি এ উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ভুল ব্যাখ্যার কারণে বিটিআরসির ওই প্রস্তাব উল্টো সমালোচনার মুখে পড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বিটিআরসির নতুন প্রস্তাব কার্যকর করা গেলে একদিকে যেমন লাভবান হবেন গ্রাহক অন্যদিকে মোবাইল অপারেটর ব্যবসায় আসবে ভারসাম্য। বিটিআরসি জানিয়েছে, প্রস্তাবনায় অন-নেট কলের রেট ১০ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে এবং অফ-নেট কলের রেট ১৫ পয়সা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে অফ-নেট কল রেট অনেক কমবে এবং এর থেকে সব অপারেটরের আয় কমবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইল সেবায় বর্তমানে অন-নেট কলের সর্বনিম্ন মূল্য হচ্ছে ২৫ পয়সা ও অফ-নেট কলের সর্বনিম্ন মূল্য ৬০ পয়সা। যে কোনো গ্রাহককে অন-নেট কলের পাশাপাশি অফ-নেট কলও করতে হয়। বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের রেগুলার অন-নেট কল রেট ৩৫ পয়সার কাছাকাছি ও রেগুলার অফ-নেট কল রেট ১ টাকার কাছাকাছি। গ্রাহককে যেহেতু অন-নেট ও অফ-নেট দুই ধরনের কলই করতে হয় তাই গড়ে প্রতি মিনিটে ৬৫-৭০ পয়সা (৩৫ পয়সা ও ১ টাকার গড়) দিতে হয়। অর্থাৎ অফ-নেট কলের উচ্চ রেটের কারণে একজন গ্রাহককে গড়ে প্রতি মিনিটে ৬৫-৭০ পয়সা দিতে হচ্ছে। অফ-নেট কলের এই উচ্চ রেটের একমাত্র কারণ অন-নেট ও অফ-নেটের সর্বনিম্ন মূল্যের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান। যা বর্তমানে ৩৫ পয়সা (অন-নেট মূল্য ২৫ পয়সা ও অফ-নেট মূল্য ৬০ পয়সা)। এই ব্যবধানের কারণে মোবাইল অপারেটররা অফ-নেট কলের রেট কমাতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। অন-নেট ও অফ-নেটের প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন মূল্য বাস্তবায়িত হলে এর ব্যবধান কমে ১০ পয়সা হবে। এর ফলে মোবাইল অপারেটররা অফ-নেট কলের রেট কমাতে পারবে। এতে করে গ্রাহকদের অন-নেট ও অফ-নেট মিলে গড়ে প্রতি মিনিটের কলরেট কমবে। পাশাপাশি অন-নেটের প্রস্তাবিত মূল্য বর্তমানে মোবাইল অপারেটরদের রেগুলার অন-নেট কল রেটের সমান হওয়ায় গ্রাহকদের গড়ে প্রতি মিনিটের কলরেট এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বর্তমানে বাংলাদেশে ৫টি অপারেটর মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবা দিচ্ছে। ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত দেশে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ১৩ কোটি ৪৮ লাখ ৫৯ হাজার। বাজারে গ্রামীণফোন ৪৫ দশমিক ২ শতাংশ গ্রাহক নিয়ে সবার উপরে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রবির গ্রাহক ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ, তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলালিংকের গ্রাহক ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ, চতুর্থ অবস্থানে থাকা টেলিটকের গ্রাহক ২ দশমিক ৮ শতাংশ, পঞ্চম অবস্থানে থাকা সিটিসেলের গ্রাহক শূন্য শতাংশ। টেলিযোগাযোগ খাতের একসময়কার নেতৃত্বদানকারী মোবাইল অপারেটর সিটিসেল বাজার প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে এখন বিলুপ্তপ্রায়। এয়ারটেল ২০১০ সালে বাংলাদেশে এসে প্রচুর বিনিয়োগ করে শেষ পর্যন্ত অল্প অংশীদারিত্ব নিয়ে বাজারে টিকে থাকতে না পেরে রবির সঙ্গে একীভূত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, যে কোনো সেবা খাতের সেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা হয় মূলত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে- সর্বোচ্চ মূল্যনিয়ন্ত্রণ যাতে করে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রাহক স্বার্থ বিঘ্নিত না হয় এবং অপরটি হচ্ছে বাজারকে সুরক্ষার জন্য সর্বনিম্ন মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। যাতে করে কেউ আগ্রাসীমূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে। বাংলাদেশের মোবাইল বাজারের অসম প্রতিযোগিতার কারণে ভয়েসকলের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্য উভয়ই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামীণফোনের অন-নেট কলসংখ্যা ৭৫ ভাগ ও অফ-নেট কল সংখ্যা ২৫ ভাগ। গ্রামীণফোনের অফ-নেট কল সংখ্যা কম হওয়ায় তাদের গ্রাহকের উপর উচ্চ অফ-নেট কল রেটের প্রভাব পড়ছে কম। বর্তমান নীতিমালার ফলে গ্রাহক বাধ্য হচ্ছে একটি অপারেটরের মধ্যে তার বেশির ভাগ কলকে সীমাবদ্ধ রাখতে। যা গ্রাহক স্বার্থ পরিপন্থি। বর্তমান অন-নেট ও অফ-নেটের ব্যবধান গ্রামীণফোনকে তার গ্রাহক ধরে রাখতে সাহায্য করছে। পাশাপাশি অন্য অপারেটর থেকে গ্রাহক ছিনিয়ে আনতে সাহায্য করছে এবং ধীরে ধীরে তার বাজারের অংশীদারিত্ব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই নীতিমালা শুধু গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের জন্য সুবিধা বয়ে আনছে যা মোবাইল সেবার ক্ষেত্রে একটি বড় বৈষম্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে রবির অন-নেট কল ৫৫ ভাগ ও অফ-নেট ৪৫। রবির ৪৫ ভাগ কল যেহেতু অফ-নেট, তাই রবির গ্রাহকের উপর উচ্চ অফ- নেট কল রেটের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি পড়ছে। একইভাবে বাংলালিংকের অন-নেট কলরেট ৫৫ ভাগ ও অফ-নেট ৪৫ ভাগ। টেলিটকের অন-নেট ২০ ভাগ ও অফ-নেট ৮০ ভাগ। ও টেলিটকের জন্য এই প্রভাব আরো বেশি যেহেতু তাদের অফ-নেট কলের পরিমাণ আরো বেশি। বর্তমান নীতিমালা কোন অপারেটরের গ্রাহকদের জন্য সুফল বয়ে আনছে। আবার কোনো অপারেটরের গ্রাহকদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যা একটি সেবার ক্ষেত্রে একটি বড় বৈষম্য এবং গ্রাহক স্বার্থ পরিপন্থি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভয়েস কলের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের উদাহরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অন-নেট ও অফ-নেটের ভিন্ন সর্বনিম্ন মূল্যের কোনো নজির নেই।