‘হ্যাঁলো, আর একখান ফোয়া হয়িদে’ (আমার ছেলে হয়েছে) বলে ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে থাকা ওবায়দুল আনন্দে কেঁদে ফেলেন। কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য স্থাপিত কুতুপালং ক্যাম্প-১ থেকে মোবাইল ফোনে খবরটি জানাচ্ছিলেন মংডিপাড়া থেকে তার শতবর্ষী মা’কে। কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসা মা রয়েছেন আরেক ক্যাম্পে। কপর্দকশূন্য ওবায়দুল টেলিফোন বুথ থেকে বিনা খরচে খবরটি জানিয়ে ধন্যবাদ দিলেন বাংলাদেশ সরকারকে। বাংলাদেশকে। বিপদাপন্ন রোহিঙ্গাদের ফোনসেবা দিতে এরইমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে খরচ করা হয়েছে কোটি টাকার বেশি। রোহিঙ্গাদের জন্য স্থাপিত ১০টি ক্যাম্পে স্থাপন করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটকের ১০টি বুথ। এখান থেকে রোহিঙ্গারা এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে কথা বলছেন একদম ফ্রি। তাদের সেবায় নিয়োজিত আছে টেলিটকের প্রায় ৩০ জন কর্মী। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এসব বুথ খোলা রাখা হচ্ছে। কুতুপালং এরিয়ায় আগে টেলিটকের ৭টি বিটিএস (নেটওয়ার্ক মেশিন) বসানো ছিল। রোহিঙ্গাদের টেলি সেবা দিতে সম্প্রতি আরো ৬টি বিটিএস স্থাপন করা হয়। এ জন্য খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাত্র ৩ দিনের মধ্যে বিটিএস বসানোর কাজ শেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। আর পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। বুধবার কুতুপালংয়ে স্থাপিত দুটি ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায় মোবাইল বুথগুলোতে রোহিঙ্গাদের ভিড়। প্রায় এক সপ্তাহ থেকে এ সেবা চালু করলেও রোহিঙ্গারা এ সেবা তেমন নিতে আসেননি। ভাষাগত সমস্যার কারণে প্রথমে তারা সরকারের এ সেবা সম্পর্কে জানতেন না। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বার্মিজ ভাষায় টেলিফোন বুথের বিষয়টি মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়। পাশাপাশি বেশ কয়েক জায়গায় বার্মিজ ভাষায় ব্যানার টানানো হয়। এরপরই বুথগুলোতে আসতে থাকেন আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা। এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিচ্ছেন তারা। গত কয়েক দিনে বুথগুলোতে রোহিঙ্গাদের ভিড় বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে টেলিটকের এমডি কাজী গোলাম কুদ্দুস বলেন, ১০টি বুথ থেকে প্রতিদিন অন্তত দেড়শ’ রোহিঙ্গা কথা বলছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন অন্য ক্যাম্পে থাকা পরিচিতদের। দিন দিন এ সংখ্যা আরো বাড়বে। সরকারের এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানান, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের ?বুথে সামর্থ্যহীন শরণার্থীদের বিনামূল্যে ফোন করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হচ্ছে। তা সম্পন্ন হলে তাদের কাছে সিম বিক্রি করা যায় কি-না, তা ভেবে দেখা হবে। তিনি বলেন, বুথগুলো থেকে প্রায় বিনামূল্যে সেবা দেয়া হচ্ছে। বিটিএসগুলো স্থাপনের জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম করতে হয়েছে, লাভের বিষয়গুলো যে টেলিটক মাথায় রাখেনি, এটাই স্বাভাবিক। যতদিন তারা আশ্রয়ে আছেন তাদের এ সুবিধা দেয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিপন্ন মানবতা দেখে আসার পর প্রধানমন্ত্রী তাদের সহায় হয়েছেন, তারা মানবতার আরেকটি রূপ দেখেছে। এটি তাদের মনবলকে দৃঢ় করেছে। আমরা মানবতার অংশ হতে চেয়েছি, টেলিটকের মাধ্যমে এটি চেষ্টা করা হচ্ছে। নিবন্ধন হওয়ার পর ১০টি বুথের প্রতিটিতে শরণার্থীদের তালিকা থাকবে, হ্যান্ডমাইকে ডেকে তাদের টেলিফোনে ধরিয়ে দেয়া হবে। এদিকে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা আপাতত কোনো মোবাইল সিম কিনতে পারবেন না। তাদের হাতে সিম তুলে দেয়াও অপরাধ হিসেবে ধরা হবে বলে সতর্ক করেছে সরকার। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা জেলা প্রশাসককে বলেছি, রোহিঙ্গাদের হাতে যাতে সিম না পৌঁছে। বিষয়টি তারা দেখভাল করছে। এদিকে বুধবার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্প-১ ও ক্যাম্প-২ এ টেলিটকের এই মোবাইল সেবা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। ঢাকা থেকে সংবাদকর্মীরাও তার সঙ্গী হন। শরণার্থী শিশুদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভিব্যক্তি নিয়ে তারানা হালিম বলেন, বিভীষিকাময় দৃশ্য নিয়ে তারা এসেছে। চোখের সামনে বাবাকে পুড়তে দেখেছে, ঘর পুড়তে দেখেছে, মাকে ধর্ষণ করতে দেখেছে। এসব ধারণা নিয়ে যখন বাংলাদেশে এসেছে, প্রধানমন্ত্রী বাচ্চাদের গায়ে হাত রেখে বলেছেন, তোমরা যেমন এতিম, আমিও এতিম। তারা বিপন্ন মানবতা নিয়ে এসেছিল, এখানে দেখেছে মানবতা কেমন হয়! এতে তাদের মনোবল দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশের রাজার প্রশংসা রোহিঙ্গা শিশুদের মুখে মুখে জানিয়ে ফেসবুকেও লিখেছেন তারানা হালিম। শিশুদের সঙ্গে কথা বলার দৃশ্য নিয়ে তোলা ছবি দিয়ে তারানা হালিম লিখেছেন, ক্যাম্পের পা?শে জড়ো হয়ে থাকা শিশুদের জিজ্ঞাসা করলাম- আমা?দের প্রধানমন্ত্রী কেমন আদর করলো? কিছুক্ষণ ওরা মুখ চাওয়া-চাও?য়ি করলো। অর্থাৎ ওরা ভালো করে বাংলা বুঝেনি। পরবর্তীতে স্থানীয় একজন (শিশুদের নিজের ভাষায়) বলে উঠ?লো, তোমাদের কাছে বাংলাদে?শের রাজার কথা জিজ্ঞেস করছেন। তখন শিশুরা বললো, অনেক আদর করেছেন, অনেক অনেক ভালো রাজা’। কো?নো শিখানো কথা নয়, অন্তর থেকে উচ্চারিত ভালোবাসার কথা। যে কথা শেখাতে হয় না। এবার ছোট্ট রো?হিঙ্গা শিশু?দের মুখে হা?সি দেখা গে?ল। ওরা আবারো বললো, ‘রাজা শেখ হা?সিনা, ভালো রাজা’। প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসেবা, অন্ন সংস্থান, আশ্রয়স্থলের পর টেলিকম সেবা দিয়ে আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এতে রোহিঙ্গারা খুশি। রাখাইন রাজ্যে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রে।