ঢাকায় নবনিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত রেনসিয়া তিরিঙ্ক মনে করেন রোহিঙ্গা সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে কিছুটা সময় লাগবে। তার মতে, এ সংকট নিরসনে রাশিয়া, চীন ও ভারতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মিয়ানমারে চীনের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি সংকট সমাধানে যে কোনো উদ্যোগের জন্য বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। রাষ্ট্রদূত তিরিঙ্ক বলেন, ইইউ চায় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এবং বলপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে সংকটের স্থায়ী সমাধান। গতকাল স্থানীয় একটি হোটেলে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাব আয়োজিত মতবিনিময় অনুষ্ঠান ‘ডিকাব টক’-এ তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সভাপতি রেজাউল করিম লোটাস।স্বাগত বক্তব্য রাখেন- সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পান্থ রহমান। ইইউ’র নতুন দূত বলেন, বাংলাদেশে তার কূটনৈতিক মিশন অত্যন্ত আনন্দদায়ক হবে বলে তিনি আশা করছেন। চলতি সপ্তাহে প্রেসিডেন্টের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করলেও প্রায় এক মাস ধরে তিনি বাংলাদশে রয়েছেন জানিয়ে বলেন, একমাসে যে অভ্যর্থনা পেয়েছি, তাতে আমি মুগ্ধ। এর আগে নেপালে এবং ভারতে দায়িত্ব পালনের কারণে বাংলাদেশ তার কাছে আগে থেকেই চেনা জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আরও ঘনিষ্ঠভাবে এ দেশ সম্পর্কে জানার এবং বুঝার সুযোগ হলো। এখানে কিছু কিছু বাংলাও শিখেছেন বলে জানান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, এমন একটা মুহূর্তে ঢাকায় দায়িত্ব নিয়েছি যখন মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তচ্যুত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। যা প্রশংসিত হয়েছে গোটা দুনিয়ায়। আজ রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এই বিপন্ন বাস্তুচ্যুতদের জরুরি আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দিয়ে মানবতার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একই সঙ্গে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল শরণার্থীর উপস্থিতি বাংলাদেশকে বড় চাপেও ফেলেছে। এ সংকট মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কফি আনান কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক কাউন্সিলের সভা থেকেও মিয়ানমারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, কূটনৈতিক নিয়ম কানুন অনুযায়ী অনেক বিষয়েই তার কথা বলার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে একজন পেশাদার কূটনীতিকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু মতামত দেয়ার সুযোগও রয়েছে। সেই সুযোগ হিসেবে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমার দীর্ঘদিন চোখের আড়ালে ছিল। যখন চোখের সামনে আসল তখন রাখাইনে নিষ্ঠুর অভিযান পরিচালনার বিষয়টি বিশ্বের নজরে এলো। একই সঙ্গে দেখা গেল মিয়ানমারে চীনের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়া এবং ভারতের সঙ্গেও মিয়ানমারের কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। এ অবস্থায় একটি বিষেয় বিবেচ্য যে, রাখাইনে সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে অবশ্যই চীন, রাশিয়া এমনকি ভারতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য চাপ জোরালো করার ক্ষেত্রেই চীন, রাশিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সামনে চলে আসছে। চাপ দিতে হবে, কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব? সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ইইউ দূত বলেন, তবে এর মধ্যেও ইতিবাচক অনেক দিক রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট এখন পুরো বিশ্বের নজরে রয়েছে। এ কারণে এ সংকট নিরসনে ইতিবাচক আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আসতে পারে এমন সম্ভাবনাও জোরালোভাবেই রয়েছে। তবে সংকটের সমাধান দীর্ঘমোয়াদি হলে সেক্ষেত্রে আগামী ছয় মাস পর শরণার্থীদের সহায়তার বিষয়সহ নতুন অনেক প্রসঙ্গ চলে আসার আশঙ্কাও সৃষ্টি হতে পারে। রাষ্ট্রদূত রেনসিয়া বলেন, আগামী ৩০শে অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কমিশনার বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ৩১শে অক্টোবর তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন। এরপর তিনি এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান তুলে ধরবেন। এ সঙ্কট নিরসনে ইইউ শুরু থেকেই বাংলাদেশের পাশে আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। রাখাইনে অভিযান বন্ধ না হওয়ায় বর্মী সেনাদের ট্রেনিংসহ বিভিন্ন সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ২৮ রাষ্ট্রের ওই জোট। তারা অস্ত্র বিক্রিসহ অন্যান্য বাণিজ্য ও যোগাযোগ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে সমপ্রতি ৮ দফা রেজুলেশন গ্রহণ করেছে। যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন বন্ধ না হলে মিয়ানমারের প্রতি আরও কঠোর হবে ইইউ। প্রশ্ন ছিল ইইউ কি মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে? জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যে রেজ্যুলেশন গৃহীত হয়েছে তা প্রতীকী প্রতিবাদ। তারপরও নির্যাতন বন্ধ না হলে তারা ‘বাড়তি পদেক্ষেপ’ নিতে পারে। যা রেজ্যুলেশনে উল্লেখ রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে তা নিয়ে আগাম মন্তব্যের কোনো ম্যান্ডেট নেই বলে জানান তিনি।