নিউ ইয়র্কের স্টুয়েভেসান্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ছেন বাংলাদেশী-বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থী তাহসিন চৌধুরী। বয়স মাত্র ১৭ হলেও স্কেটবোর্ড বা ভিডিও গেমসের প্রতি অত ঝোঁক নেই তার। বরং, এই বয়সেই নেমে পড়েছেন নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটে নির্বাচিত হওয়ার দৌঁড়ে। অথচ, এখনও তার নিজেরই ভোট দেওয়ার বয়স হয়নি। আসছে সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক রাজ্য সিনেটে মধ্যবর্তী নির্বাচন। ডিস্ট্রিক্ট ১৩ আসনে ডেমোক্রেট দলীয় রাজ্য সিনেটর জোসে পেরাল্টার বিরুদ্ধে লড়ার পরিকল্পনা করছেন তাহসিন।স্কুলের ছুটির দিনগুলোতে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটে তার। তাকে নিয়ে ইতিমধ্যে হই হুল্লোড় পড়ে গেছে। বড় করে ফিচার করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কারের মতো প্রকাশনা।
একদিন স্কুলেই তাহসিনের সঙ্গে কথা বলেছেন নিউ ইয়র্কারের সাংবাদিক লরা পার্কার। তৃণমূলে নিজের প্রচারাভিযান নিয়ে তাহসিনের ভাষ্য, ‘এটা তেমন কঠিন কাজ নয়। আপনার শুধু দরকার সামর্থ্যবান কিছু মানুষ।’ ২০ জন উপদেষ্টা সমেত তাহসিনের প্রচার শিবির। এদের বেশিরভাগই এখনও কিশোর। নির্ধারিত সময়ের পর বাড়ির বাইরে থাকা বারণ! তার কোষাধ্যক্ষ তাইমুর খোলদনায়কের বয়সও ১৭। তাকে নিয়ে তাহসিন বলেন, ‘সে বেশ কিছু বই পড়েছে। ব্যাস! নির্বাচনী প্রচারণায় অনুদান ও ব্যয়ের হিসাব কীভাবে রাখতে হয়, সে তা বের করে ফেলেছে।’
স্কুলে ছাত্র ইউনিয়নের একটি বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাহসিন। পরনে আগাগোড়া কেতাদুরস্ত পোশাক। ‘আমি সবসময়ই এমন পোশাক পরি, মূলত প্রচারণার কারণে,’ ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে নিজেই ফের বললেন, আমি আগে যা পরতাম, তা-ও খুব আলাদা কিছু ছিল না। নিজের চিফ অব স্টাফ ও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মিলে তাহসিন বিতর্কের এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন, যাকে বলা হয় ‘স্প্রেডিং’। এভাবে তাহসিন মিনিটে সর্বোচ্চ সাড়ে তিনশো শব্দ বলে ফেলতে পারেন।
আকস্মিকভাবেই রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গত বছর স্কুলের ছাত্র ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এক পর্যায়ে নিউ ইয়র্ক শহরের শিক্ষা বিভাগের শিক্ষা নীতি বিষয়ক প্যানেলে উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। এই পদে থাকার সময় তাহসিন ভেবেছিলেন, এবার বুঝি শিক্ষা বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জায়গায় পৌঁছেছেন তিনি। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। তিনি নিজেই বললেন, ‘এসব প্যানেলে শিক্ষার্থীরা অনেকটা অলংকারের মতো।’ বিরক্ত হয়ে, এই প্যানেলে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা বৃদ্ধি করতে বিল প্রস্তাব করলেন তিনি। আর এটিই তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্যতম।
গত বছরের মে মাসে নিজের প্রার্থীতা ঘোষণা করেন তাহসিন। ডিস্ট্রিক্ট ১৩ আসনের রাজ্য সিনেটর পেরাল্টা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডেমোক্রেটিক কনফারেন্স’ নামে একটি ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটরদের একটি গ্রুপে জোগদান করার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুদ্ধ হন তিনি। কারণ, এই গ্রুপটি ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটরদের গ্রুপ হলেও, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি রিপাবলিকানদের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। তাহসিনের ভাষ্য, ‘পেরাল্টা দাবি করেন যে তিনি প্রগতিশীল। কিন্তু তার এই ছলচাতুরি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই।’ ডিস্ট্রিক্ট ১৩-এর করোনা, পূর্ব এলমার্স্ট, এলমার্স্ট, জ্যাকসন হাইটস ও উডসাইডের মতো কর্মজীবী শ্রেণি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভোট পাওয়ার আশা করছেন তিনি। এর মধ্যে জ্যাকসন হাইটস বাঙালি অধ্যুষিত। পেরাল্টা যে একজন ডেমোক্রেট ছদ্মবেশের রিপাবলিকান, তা-ই তাহসিন বোঝাতে চান ভোটারদেরকে। তাহসিনের পিতা নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটনের একটি খাবারের দোকানে কাজ করেন। তার মা পত্রিকা বিতরণ করেন। ‘তারা অত টাকা কামায় না,’ ব্যখ্যার সুরে বললেন তিনি।
এদিকে তার স্কুল ইউনিয়ন সভার শুরু হয়েছে। উপস্থিত ছিলেন অ্যালেক্সা ভ্যালেন্টিনো, যিনি ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তার ডেপুটি চীফ অব স্টাফ। ছিওলেন তাহসিনের প্রচার শিবিরের প্রধান অর্থ নিরীক্ষণ কর্মকর্তা ও অনুষ্ঠান সমন্বয়ক কারমেন বেনিতেজ। সরকারী শিক্ষক ম্যাট পোলাজো। তবে জ্যেষ্ঠ ককাস প্রেসিডেন্ট স্যান্ডলার কিছুক্ষণ ছিলেন। সবাই একটি টেবিলের চারদিকে বসলেন। সব ক’টি চেয়ার সেখানে নেই। ভ্যালেন্টিনো অনেকটা অনুযোগের সুরে বলে উঠলেন, ‘মানুষ আসে, আর চেয়ার নিয়ে চলে যায়।’
আলোচনা চলছে কিছু ইউনিয়ন সদস্যের ভোটাধিকার রদ করা নিয়ে। কিন্তু আলোচনা অর্ধেক চলার মধ্যেই স্যান্ডলার ফোনে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তাহসিন কিছুটা বিরক্ত হলেন। হাসতে হাসতে স্যান্ডলার বললেন, ‘আমি আগামী বছর এখানে থাকবোও না।’
গত হ্যালোইনে স্কুলেই ছিলেন তাহসিন। ওইদিনই পাশের এক রাস্তায় এক সন্ত্রাসী ট্রাক চালিয়ে দেয় পথচারীদের ওপর। তাহসিন জানেন, ওই ঘটনার পর উগ্র চরমপন্থা নিয়ে আমেরিকানদের ভয় আরও পোক্ত হয়েছে। তার ভাষ্য, ‘একজন মুসলিম প্রার্থী হিসেবে, আমি মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে থাকবো। কারণ, এই সম্প্রদায় প্রগতিশীল আমেরিকান ধ্যানধারণার পাশে থাকে।’
এখন পর্যন্ত তাহসিনের বয়স কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ মনে করেন, রাজ্য সিনেটর হওয়ার মতো মানসিকভাবে আমি এখনও সমর্থ হইনি, কারণ আমার মস্তিস্ক অতটা শানিত হয়নি।’ কিন্তু তার তারুণ্যের একটা ভালোদিকও আছে। মানুষ ভাবে বেশিরভাগ রাজনীতিবিদেরই কোনো না কোনো এজেন্ডা আছে। কিন্তু তাহসিন রাজনীতিতে এসেছেন বেশিদিন হয়নি। ফলে তার ওই ধরণের কোনো দুরভিসন্ধি নেই। কৌতুক করে তিনি বলেন, ‘অনেকটা যেন এমন যে, আমি দুনিয়ায় অত বেশিদিন বাস করিনি।’
সন্ধ্যার দিকে প্রচার শিবির নিয়ে শহরের মাঝে নিজেদের কার্যালয়ে যান তাহসিন। এক পারিবারিক বন্ধু নিজের অফিসেই একটু জায়গা দিয়েছেন তাকে। শিক্ষক পোলাজো বলেন, ‘রাতে তিন-চার ঘন্টা ঘুমানোর সময় পায় সে।’
সপ্তাহান্তের দিনে, তাহসিন প্রচারণার কাজ করেন না। তখন তিনি চলে যান কুইন্সে অবস্থিত খান’স টিউটোরিয়ালে। ইন্টারনেট বাজারজাতকরণ সমন্বয়ক হিসেবে সেখানে চাকরি করেন তিনি। অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই তিনি এই কাজে দক্ষতা বাড়ান। এমনকি একটি প্রতিষ্ঠানের মালিককে জানান যে, তিনি তাদের ওয়েবসাইট নতুন করে ডিজাইন করে দিতে চান। তখন তাহসিন অবশ্য নিজেরই একটি বাজারজাতকরণ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন।
এক অদ্ভুত অভ্যাস আছে তার। সেটা হলো, প্রযুক্তিপণ্য ভাঙা! পোলাজো বলেন, এমনকি কামড় দিয়ে মোবাইল ফোন ভেঙেছে সে, এমন কাহিনীও ঘটেছে। সম্প্রতি, তাহসিন ও তার ভাবা পুলিশের একটি নিলামে অংশ নেন। সেখানে মাত্র ৫০ ডলারের বিনিময়ে ২০টি ব্যবহৃত ল্যাপটপ কিনেন তারা! নিজের স্টুডেন্ট ইউনিয়ন কক্ষে এসব ল্যাপটপ সংরক্ষণ করে রেখেছেন তিনি। প্রচারণার অর্থায়ন নিয়ে যখন দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়, তখন হুট করেন একটি ল্যাপটপ নিয়ে দেওয়ালে ছুড়ে মারেন! তাহসিন বলেন, ‘এটা অনেকতা রাগ কমানোর কৌশল। আছাড় মারলে মাঝেমাঝে ল্যাপটপের কিবোর্ড বেরিয়ে আসে, তার বেরিয়ে আসে।’ রাগ কমানোর এই কৌশল নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকলেও পোলাজোর এ ব্যাপারে আপত্তি নেই। তাহসিনকে নিয়ে তার মূল্যায়ন হলো, ‘সমর্থনের পরিমাণের দিকে তাকালে, সম্ভাবনা খুবই কম। তার বয়স এখনও আঠারও হয়নি। এটি তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। অন্য দিকে, এ-ও মনে রাখতে হবে যে, নতুন ও ব্যতিক্রমী প্রার্থীরা আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভালো করেন। আমাদের প্রেসিডেন্টের কথাই একবার ভাবুন না!’