প্রধানমন্ত্রীর ভবিষৎবাণী সত্যি করলো টাইগাররা (১৭ মার্চ) অনেক কর্মসূচি। দিনভর ব্যস্ততা। কিন্তু তাই বলে ক্রিকেট পাগল প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ দেখবেন না, তা কি করে হয়। গণভবনে নানা ব্যস্ততা শেষ করে টিভির সামনে বসলেন প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গে তাঁর নিকটাত্মীয় এবং কয়েকজন ব্যক্তিগত স্টাফ। মিরাজ আউট হবার পর, সবাই আশা ছেড়ে দিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তখনও বললেন, ‘বাংলাদেশ জিতবেই।’
শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ১২ রান ট্রাইকে মোস্তাফিজ। প্রথম বল ডট। এরপর এক রান নিতে গিয়ে আউট মোস্তাফিজ। স্ট্রাইকে এলো রিয়াদ। প্রধানমন্ত্রী বললেন ‘এবার একটা চার আর একটা ছয় মারবে, দেখো।’ প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যত বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হলো। উত্তেজনার পারদে ঠাসা ম্যাচ শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আব্বার জন্মদিন কাল। আজ কীভাবে হারে বাংলাদেশ। আমি জানতাম বাংলাদেশ জিতবেই।’
শুধু এটাই প্রথম নয়, ক্রিকেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অধিকাংশ ভবিষ্যতবাণীই সত্যি হয়েছে বিভিন্ন সময়।
এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। চরম নাটকীয়তা।হারের মুখে থেকে জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। শেষ চার বলে দরকার ১২ রান। এটা কি সম্ভব? কিন্তু ক্রিকেটে যে অনেক কিছুই সম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে অবিশ্বাস্য এবং মনে রাখার মতো এক জয় ছিনিয়ে নিল টাইগাররা।
শেষ ওভারের পঞ্চম বলে যখন ছক্কা হাঁকালেন রিযাদ, পুরো দল ছুটে এলো মাঠের মাঝখানে। শুরু হলো উৎসব। যেন বিরাট কোনো টুর্নামেন্ট জিতে ফেলেছে দল। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বীরত্বে এক বল বাকি থাকতে যেভাবে ২ উইকেটে নাটকীয় জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ, সেটা বড় কোনো টুর্নামেন্ট জয়ের মতোই আনন্দের, গৌরবের।
প্রথমে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কা করেছিল ৭ উইকেটে ১৫৯ রান। জবাবে রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তায় ৮ উইকেট হারিয়ে (এক বল বাকি থাকতে) জয় তুলে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ।
প্রেমদাসার উইকেট পুরোপুরি ব্যাটিং। এখানে ১৬০ রানের টার্গেট খুব বড় কিছু নয়। তবে পরিস্থিতি সহজ ছিল না মোটেও। বড় ম্যাচ। অনেক চাপ। তার উপর আবার গ্যালারি ভর্তি দর্শক। যারা শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা বলে গলা ফাটাচ্ছে। চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে ব্যাটসম্যানদের উপর। বহুমুখী চাপ। দরকার মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলা।
কিন্তু আগের ম্যাচের মতো এ ম্যাচেও ব্যর্থ ওপেনার লিটন দাস। ০ তে তিনি ফিরলেন দারুণ চাপ তৈরী করে। সৌম্য রানের মধ্যে নেই। যে কারণে তিন নম্বরে নামানো হয় সাব্বির রহমানকে। অনেক দায়িত্ব ছিল তার উপর। বেশ ভালোই শুরু করেছিলেন। কিন্তু ৮ বলে ১৩ করার পর আউট হয়ে যান সাব্বির। ৩৩ রানে নেই তিন উইকেট।
এক প্রান্তে দারুণ খেলতে থাকা তামিম ইকবালের সঙ্গে জুটি বাঁধেন ফর্মের তুঙ্গে থাকা মুশফিকুর রহিম। দেশের সেরা দুই ব্যাটসম্যান ক্রিজে। এ জুটির দিকে তাকিয়ে দল। বেশ ভালোই এগুচ্ছিলেন। তরতর করে রান করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২৫ বলে ২৮ করার পর দুর্দান্ত এক ক্যাচের শিকার হন মুশফিক। দলের জন্য যা বিরাট আঘাত।
তামিম উইকেটে থাকলে খুব বেশি চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু তিনিও ফিরে গেলেন এর কিছু পর। ৪২ বলে ৫০ করে তামিম ফিরে গেলে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় শ্রীলঙ্কা। সৌম্য টানাই ব্যর্থ হচ্ছেন। তা তিনি ওপনিংয়ে নামেন, তিন নম্বরে ব্যাট করেন, অথবা মিডল অর্ডারে। দলের দারুণ প্রয়োজনের সময়ে এ ম্যাচেও ব্যর্থ। ১১ বলে ১০ রান করে বিদায় নেন দলের বিপদ বাড়িয়ে।
আঙুলের সমস্যা হয়তো এখনও কিছুটা রয়ে গেছে। মাত্র ২ ওভার বল করেছেন। ব্যাট করতেও নামলেন ৬ নম্বরে। অসুস্থ আঙুল নিয়েই যে তাকে দলের প্রয়োজনে লড়তে হবে। সে এক কঠিন দায়িত্ব সাকিব ও রিযাদের উপর।
২৪ বলে দরকার ৪০ রান। ১১ রান এলো ১৭তম ওভারে। এরপর ১৮ বলে দরকার ২৯ রান। পেসার উসুরু উদানা আসলেন ১৮তম ওভার করতে। এ ওভারটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল দলের জন্য। একটা ছ্ক্কা ও একটা চার অন্তত মারার দরকার ছিল। কিন্তু সেটা তো হয়-ই নাই বরং ৯ বলে ৭ করার পর ফিরে যান সাকিব। এ ওভার থেকে আসে মাত্র ৬ রান।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা কার্যত অনেকটাই শেষ। শেষ দুই ওভার দরকার ২৩ রান। রিয়াদের সঙ্গে উইকেটে মিরাজ। কঠিন সমীকরণ সামনে। মিরাজ ওভারের শেষ ওভারে হয়ে যান রান আউট। তারপরেও ১৩ রান আসে ১৯তম ওভার থেকে। ৬ বলে দরকার ১২ রান।
সমস্যা হলো স্ট্রাইক এন্ডে মোস্তাফিজ। প্রথম বল থেকে কোনো রান নিতে পারলেন না মোস্তাফিজ। উদানার দ্বিতীয় দলটি ছিল পুরোপুরি নো বল। মোস্তাফিজের মাথার উপর দিয়ে গেলেও সেটাকে নো বল ধরেননি শ্রীলঙ্কান আম্পায়ার। মোস্তাফিজ বলে ব্যাট না লাগাতে পারলেও দৌঁড়ে এক রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে যান।
কিন্তু রিয়াদসহ পুরো দল এটিকে নো বলের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আম্পায়ার সেটা উড়িয়ে দিলে প্রতিক্রীয়া দেখায় বাংলাদেশ দল। খেলা বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ। পরে অবশ্য ক্রিজে ফিরে যান রিয়াদ । শেষ চার বলে দরকার পড়ে ১২ রান।
স্ট্রাইকেন্ডে রিয়াদ। এ এক কঠিন দায়িত্ব। কঠিন সমীকরণ। উদানার তৃতীয় বলে শুয়ে পড়ে চার হাঁকালেন রিয়াদ। পরের বলটি ছিল ফুলটস। মিড উইকেট মেরে নেন ২ রান। শেষ দুই বলে দরকার ছিল ৬ রান। তবে রিয়াদের বীরত্বে এক বল আগে থাকতেই মনে রাখার মতো জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। পঞ্চম বলটি ছিল ফুল লেন্থের। সেটাকে ছ্ক্কা হাঁকিয়ে ২ উইকেটের অবিস্মরণীয় জয় তুলে নেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ১৮ বলে ৪৩ রানের বীরত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন রিয়াদ।
এর আগে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৪১ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাবার পরও ৭ উইকেটে ১৫৯ রান তুলে শ্রীলঙ্কা।
সন্ধ্যায় টস ভাগ্যটা বাংলাদেশের ছিল আবারও। প্রায় পৌনে দুই মাস পর দলে ফিরেই প্রথম ওভারটা নিজের হাতে তুলে নেন দায়িত্বশীল অধিনায়ক। প্রথম ধক্কাটা নিজেই সামলানোর দায়িত্ব নিলেন তিনি। অসাধারণ করেছেন এ ওভারটি। গুণে গুণে মাত্র তিন রান দিয়েছেন। পরের ওভারটা ব্যয়বহুল গেছে রুবেলের। তবে তৃতীয় ওভারের প্রথম বলেই ওপেনার গুনাথিলকাকে ৪ রানে বিদায় করে শুরুতেই খেলা জমিয়ে দেন সাকিব।
অনেক দিন ধরেই নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছিলেন কাটার বয়। পেমাদাসায় আাজ শুরুতেই অন্যরকম দেখাচ্ছিলো মোস্তাফিজকে। চতুর্থ ও নিজের প্রথম ওভারের শেষ বলে কুশল মেন্ডিসকে ( ১১ রান) বিদায় করেন কাটার বয়। এরপর পঞ্চম ওভারে ৭ রান দেন মিরাজ। ৬ষ্ঠ ওভার করতে এসে আগুন ঝরান মোস্তাফিজ। সেই আগুনে পুড়েন অভিজ্ঞ উপল থারাঙ্গা, ৫ রান করে। পরের বলে এক রান দেওয়ার পর ওভারের চতুর্থ বলে আরেকবার জ্বলে ওঠেন মোস্তাফিজ। নতুন ব্যাটসম্যান সানাকাকে দাঁড়াতেই দেননি। ০ রানে বিদায় করে লঙ্কানদের মহা বিপদে ফেলে দেন মোস্তাফিজ।
মিরাজের ও রিয়াদের ওভার দুটি কোনোমতো পার করলেও নবম ওভারের প্রথম বলেই উইকেট। গত তিন ম্যাচে উইকেটের মুখ দেখেননি। প্রচণ্ড চাপে ছিলেন। অবশেষে উইকেট পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচেন স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ। ১১ বলে মাত্র ৩ রান করেন জীবন মেন্ডিস।
৯.৪ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ৫০ রান তুলে শ্রীলঙ্কা। এরআগে ৬ ওভারের পাওয়ার প্লেতে মাত্র ৩৫ রান তুলতে পারে স্বাগতিকরা। টুর্নামেন্টে এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বাজে শুরু। বাজে শুরু পরও শ্রীলঙ্কার ফিনিশিংটা ছিল অবিশ্বাস্য।
৪১ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাবার পর অবশ্য দাঁড়িয়ে যান দুই পেরেরা। কুশল পেরেরা ও থিসারা পেরেরা। ১০০ রানের মধ্যে স্বাগতিকদের গুটিয়ে ফেলার যে প্রবল সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল, সেটা নস্যাৎ করে দেন এ দুজন। বরং শুরুর বিপর্যয় সামলে দলকে ধেই ধেই করে টেনে নিতে থাকেন উপরে।বাংলাদেশকে হতাশ করে ৩২ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন কুশল পেরেরা।
৯৭ রানের পার্টনারশিপ গড়ার পর ৪০ বলে ৬১ রানের তুখোড় ইনিংস খেলে সৌম্য সরকারের বলে আউট হন কুশল পেরেরা। ওদিকে ৩৩ বলে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন অধিনায়ক থিসারা পেরেরা। বাংলাদেশকে হতাশ করে শ্রীলঙ্কা থামে ১৫৯ রানে, ৭ উইকেটে। ৩৭ রানে ৫৮ রান করেন থিসারা পেরেরা।
মোস্তাফিজ ৩৯ রানে দুই উইকেট নেন। দারুণ বল করেছেন মিরাজ। মাত্র ১৬ রান দিয়ে এক উইকেট নেন এ অফ স্পিনার। সাকিব করেছেন ২ ওভার, দিয়েছেন ৯ রান। নিয়েছেন এক উইকেট।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ফল: দুই উইকেটে জয়ী বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কা ইনিংস: ১৫৯/৭ (২০ ওভার)
(দানুশকা গুনাথিলাকা ৪, কুসল মেন্ডিস ১১, কুসল পেরেরা ৬১, উপুল থারাঙ্গা ৫, দাসুন শানাকা ০, জীভন মেন্ডিস ৩, থিসারা পেরেরা ৫৮, ইসুরু উদানা ৭*, আকিলা ধনঞ্জয়া ১*; সাকিব আল হাসান ১/৯, রুবেল হোসেন ১/৪১, মোস্তাফিজুর রহমান ২/৩৯, মেহেদী হাসান মিরাজ ১/১৬, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ০/২৯, সৌম্য সরকার ১/২১)।
বাংলাদেশ ইনিংস: ১৬০/৮ (২০ ওভার)
(তামিম ইকবাল ৫০, লিটন দাস ০, সাব্বির রহমান ১৩, মুশফিকুর রহিম ২৮, সৌম্য সরকার ১০, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৪৩*, সাকিব আল হাসান ৭, মেহেদী হাসান মিরাজ ০, মোস্তাফিজুর রহমান ০, রুবেল হোসেন ০*; নুয়ান প্রদীপ ০/১০, আকিলা ধনঞ্জয়া ২/৩৭, আমিলা আপোনসো ১/১৯, থিসারা পেরেরা ০/২০, দানুশকা গুনাথিলাকা ১/২৪, জীভন মেন্ডিস ১/২৪, ইসুরু উদানা ১/২৬)।
প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ: মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (বাংলাদেশ)।