তরুণদের মন বুঝুন, ভালোবাসুন

২০১৬ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ। দেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। আর কর্মক্ষম মানুষ আছেন ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। কিন্তু আমরা এই তরুণদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। ফলে যে তরুণ হতে পারতেন পরিবারের ভরসা এবং দেশের সম্পদ, সেই তরুণ এখন সমাজের বোঝা। বেকারত্বই এখন বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা। কিন্তু সরকার বেকার সমস্যা দূর করতে কার্যকর বা টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হয় না। আমাদের সরকারগুলো তরুণদের কথা ভাবে না। ভাবে সুবিধাবাদী একটি গোষ্ঠীর কথা, যাঁরা বৈধ–অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করেন। যঁারা বিদেশে সেকেন্ড হোম বানান।

 তরুণেরা আন্দোলন করছেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু তাঁরা এও জানেন যে সরকারি চাকরিতে সবার জায়গা হবে না। যেমন ৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশ নিয়েছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩২ জন। এর মধ্যে বড়জোর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী চাকরি পাবেন। ৩৭তমে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৬ জন। মেধাবী তরুণেরা বছরের পর বছর পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পান না বলেই কোটার সমস্যাটি তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সরকারি অফিস, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি। সেই শূন্য পদগুলো পূরণ হলে অনেকের কর্মসংস্থান হতো। তরুণদের কাছে সরকারি চাকরির বিকল্প হলো বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন খাত। কিন্তু সেখানেও মন্দা চলছে। বিনিয়োগ বাড়ছে না। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার মানুষকে শেয়ারবাজারে আকৃষ্ট করতে রোড শো করেছিল। সে সময় অনেক তরুণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

কিন্তু সেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশই থাকছে। সংস্থাটির মতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০ লাখ, ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৬০ হাজার। কিন্তু এসব তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রকৃত বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। বেকারের সংখ্যা নিয়ে গত বছর জাতীয় সংসদেও বিতর্ক হয়েছিল। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছিলেন, সরকারি দলের সাংসদ যে ২৬ লাখ বেকার বলে দাবি করেন, সেটি ভুয়া। শুধু ঢাকা শহরেই ২৬ লাখ বেকার রয়েছেন। আর বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে জানিয়েছিলেন, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। এর মধ্যে ১০ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। ৫ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছে। বাকি ৫ কোটি মানুষ কোনো কাজ পায় না।

২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্ট–এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। স্নাতক বেকারের সংখ্যা ৪৭ না হয়ে ২৭ হলেও সেটি কম উদ্বেগজনক নয়। বাংলাদেশ লেখাপড়া শিখিয়ে একটি বেকার শ্রেণি তৈরি করছে। বহু বছর আগে আমাদের এক বন্ধু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের উচ্চ ডিগ্রি নিয়েও যখন দেখলেন দেশে ভালো কোনো চাকরি পাচ্ছেন না, তখন তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে সাধারণ কর্মীর চাকরি নিয়ে যান, আর মনের দুঃখে নিজের শিক্ষাগত সনদগুলো বিমান থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলেন। এ রকম বেদনাদায়ক ঘটনা আরও অনেক আছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কাজের উপযুক্ত করতে পারিনি। ফলে দেশের শিক্ষিত তরুণেরা বেকার থাকছেন, আর বিদেশ থেকে মোটা মাইনের দক্ষ জনশক্তি আমদানি করা হচ্ছে। এই বৈপরীত্য কবে কাটবে?

সম্প্রতি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের একটি আলোচনা সভাতেও তরুণদের কর্মসংস্থান ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়টি উঠে আসে। এতে সাবেক সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন ‘মুক্তিযুদ্ধের গৌরব: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সতর্কতা’ শীর্ষক উপস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করার কথা বলেছেন। এর বাধা ও বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কিছু ভুল, দুর্বলতা ও ত্রুটিবিচ্যুতির সুযোগ নিয়ে’ অনুপ্রবেশকারীরা সামাজিক ও পেশাগত আন্দোলনকে (তরুণদের কোটা আন্দোলনসহ) বিপথগামী করছে। সেই সংলাপে বক্তারা ‘বাইরের শত্রু’ সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেও ‘ভেতরের শত্রুদের’ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। সব দুর্বলতা ও ব্যর্থতার দায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করেছেন। তবে কারও কারও বক্তব্যে আত্মসমালোচনাও ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন বললেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য হলে হলে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যও দায়ী।

আশার কথা, সরকারের নীতনির্ধারকেরা তরুণদের আবেগ উপেক্ষা করলেও সেদিন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সংলাপে অংশগ্রহণকারী বক্তারা ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ন্যায্যতা স্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বহাল রেখে কোটা সংস্কার করতে হবে। আন্দোলনকারীরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটা না রাখার কিংবা কোটা পুরোপুরি বাতিলের কথা বলেননি। মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা সংরক্ষণের পক্ষপাতী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের জন্য এই কোটার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’ এ রকম মনোভাব অনেকেই পোষণ করেন। কিন্তু সাহস করে বলেন না। মনে রাখা দরকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজকের তরুণেরাও আন্দোলন করছে সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণদের মধ্যে যে প্রচণ্ড হতাশা রয়েছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আন্দোলনে। অতএব তাঁরা পোস্টারে কী লিখেছেন, শরীরে কী স্লোগান উৎকীর্ণ করেছেন, সেটিকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক নয়। এসব ছিল ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া, শ্লেষ। অনুপ্রবেশের দোহাই দিয়ে কোনোভাবেই তরুণদের এই আন্দোলনকে খাটো করে দেখা কিংবা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ঠিক হবে না। সেদিনের সংলাপে বক্তারা যা বলেননি, তা হলো রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা বরাবর তরুণদের মনোভাব ও আবেগ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকারের জন্য এ কথা প্রযোজ্য। রাষ্ট্র চলেছে গতানুগতিক ধারায়। তরুণেরা নতুন স্বপ্ন দেখেছেন, এখনো দেখছেন।

তরুণদের রক্ত ও যুদ্ধে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সেই বাংলাদেশে সব নাগরিকের মৌলিক ও মানবিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হওয়ার কথা। মানুষে মানুষে বৈষম্য লোপ না করতে পারলেও সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে বিরাট বৈষম্য আছে, সেটি দূর করা ছিল রাষ্ট্রের জরুরি দায়িত্ব। শুধু কোটা সংরক্ষণ করে পেছনের মানুষকে সামনে নিয়ে আসা যাবে না। তরুণেরা শুধু কোটা সংস্কার চান না। তাঁরা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যেরও অবসান চান। আজকের তরুণেরা সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে চান, যেখানে হেফাজতিদের পরামর্শে পাঠ্যবই বদলানো হবে না, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়েও স্ববিরোধী অবস্থান থাকবে না।

তাই সরকারের নীতিনির্ধারকদের বলব, তরুণদের সমস্যা অনুধাবন করুন। তাঁদের মন বুঝতে চেষ্টা করুন। তরুণদের ভালোবাসুন। তাঁরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাঁদের প্রতি রাষ্ট্র এমন আচরণ করতে পারে না, যা তাঁদের আহত ও ব্যথিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা সব সময়ই তরুণদের অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে এসেছেন। বর্তমান সংসদের কথা যদি বাদও দিই, আগের চারটি সংসদেও তরুণদের বেকারত্ব বা কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

 শুধু মুখের কথায় নয়; সরকারের কাজ, আচরণ ও পরিকল্পনায় তরুণদের জায়গা থাকতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *