রাজধানীর আশকোনার হাজি ক্যাম্পের কাছের রেলগেট। গেট পরে যাওয়ার পরও নিচ দিয়ে পারাপার হচ্ছে পথচারীরা। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
রাজধানীর আশকোনা হজ ক্যাম্প রেলক্রসিং পেরিয়েই বিমানবন্দর রেলস্টেশন। প্রতিদিন এই স্টেশন দিয়েই ঢাকায় আসা-যাওয়া করে শতাধিক ট্রেন। এ কারণে যানজট এখানে লেগেই থাকে। সকাল ও রাতের বেলা মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে গেলে আশকোনার রেলক্রসিংয়ের যানজট আরও ছড়িয়ে যায় বহুদূর। তখন এটি উত্তরে জসীমউদ্দিন মোড়, দক্ষিণের বলাকা ভবন, পশ্চিমে শাহজালাল বিমানবন্দরের ক্যানপি পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। শুধু আশকোনোয় নয়, রাজধানী যেসব রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নেই তার সবগুলোরই একই দশা। রেলক্রসিংয়ের বার ফেলে রাখার কারণে পুরো রাজধানীতে যান চলাচল বন্ধ থাকে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময়।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজধানীর ওপর দিয়ে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। আর এমনটি হলে রেলক্রসিংকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরীতে যানজটের মাত্রা আরও কয়েক গুণ বাড়বে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকা থেকে টঙ্গী রেলস্টেশন পর্যন্ত মোট ৩১টি বৈধ রেলক্রসিং রয়েছে। প্রতিদিন আন্তনগরের বিভিন্ন রুটের ৫১টি ট্রেন ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে। ট্রেন চলাচলের কারণে সারা দিন ১০২ বার প্রতিটি রেলক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধকগুলো ফেলা হয়। প্রতিবার গড়ে তিন মিনিট করে রেলক্রসিংয়ের বন্ধ রাখা হয়। সেই হিসেবে একটি রেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে প্রতিদিন ৩০৬ মিনিট বা পাঁচ ঘণ্টা ছয় মিনিট করে যান চলাচল বন্ধ থাকে। কোনো কোনো দিন সাত থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত প্রতিটি রেলক্রসিংয়ের বার ফেলে রাখা হয়।
আশকোনার হাজি ক্যাম্পের কাছের রেলগেট। ট্রেন আসবে বলে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে গেট। অপেক্ষায় যানবাহন। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সরেজমিন দেখা গেছে, আশকোনা রেলক্রসিংয়ের পাশে রেল লাইনের ওপর আড়াআড়ি বসে আছেন ফলবিক্রেতারা। কমলাপুরগামী একটি ট্রেন কাছাকাছি এলে ফলের ঝুড়িগুলো একটু পাশে সরিয়ে নিলেন। মিনিট দশেক পর পাশাপাশি দুটি লাইন দিয়ে চলে গেল আরও দুটি ট্রেন। তখন ফলের ঝুড়িগুলো তুলে ক্রসিংয়ের চারটি নিয়ন্ত্রণকক্ষের সামনে রাখলেন তাঁরা।
ট্রেন আসার আগে রেলক্রসিংয়ের চারটি প্রতিবন্ধক ফেলার আগে বেঁধে যায় হুড়োহুড়ি। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, পিকআপ ভ্যানসহ যানবাহনগুলো দ্রুত পারাপারের চেষ্টা করতে থাকে। প্রতিবন্ধকগুলো ফেলার পর হুড়োহুড়ির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মোটরসাইকেল আরোহীদের অনেকে সেগুলো উঁচু করে বের হয়ে যান। এই সুযোগ নেন পথচারীরাও। বাধ্য হয়ে অনবরত হুইসিল বাজিয়ে ধীর গতিতে চলতে থাকে ট্রেনগুলো। ট্রেনের ধীর গতির কারণে যানজট ছড়িয়ে যায় বিমানবন্দর চত্বর পেরিয়ে কার পার্কিং এলাকা পর্যন্ত।
তবে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর যানজট আরও দীর্ঘ হয় বলে জানান বিমানবন্দর ট্রাফিক জোনের সহকারী কমিশনার শচীন মৌলিক। তিনি বলেন, দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালাল বিমানবন্দর রয়েছে এই এলাকায়। রেলক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধকগুলো অনেক সময় ২০ মিনিটেরও বেশি পড়ে থাকে। ট্রেন চলে গেলেও জটলা কাটে না। তাই পশ্চিম প্রান্ত বিমানবন্দর থেকে গাড়িগুলো চত্বর ঘুরতে পারে না। সন্ধ্যার পর যানজট বিমানবন্দরের ক্যানপি এলাকায় চলে যায়। এই সমস্যার কথা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
রাজধানীর তেজগাঁও রেলক্রসিংয়ে গেট পরে যাওয়ার পরও পথচারীদের বেপরোয়া চলাচল। ছবি: সংগৃহীত
রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের মতে রেলক্রসিংয়ে আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন হলে যানজট কিছুটা কমতে পারে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেভেল ক্রসিংয়ের মান উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রকল্প চলমান রয়েছে। এটি শেষ হলে ও গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হলে আশা করছি বর্তমান সমস্যার কিছুটা উন্নতি হবে। রেললাইনের পাশে যেকোনো দোকানপাটই অবৈধ। এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু উচ্ছেদের পর আবারও দোকান বসে যায়। তা ছাড়া রেলক্রসিং গেটের পাশে রেলের কর্মচারীরা যদি দোকানপাট বসিয়ে থাকে তাহলে সেটি যাচাই করে তাদের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু বিমানবন্দর এলাকায়ই নয়, রাজধানীর প্রায় রেলক্রসিংয়ে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি রেলক্রসিং ঘুরে দেখার সময় একই চিত্র দেখা গেছে। রেলক্রসিংয়ে কারণে যানজট সৃষ্টি সারা ঢাকায়।
হজ ক্যাম্প রেলক্রসিং থেকে কারওয়ান বাজার এফডিসি রেলক্রসিংয়ের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। দূরত্বের ব্যবধান থাকলেও এখানেও দখলদারদের দাপট। রেলক্রসিংয়ের উত্তর পাশে রয়েছে অসংখ্য ঝুপড়ি ঘর। প্রতিদিন সকালে রেললাইনের ওপর বসে মাছের বাজার। দুপুর থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মাদকের ব্যবসা। ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকালে রেলক্রসিংয়ের পাশে এই মাছবাজারে ঘটেছিল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এখানেই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকামুখী যমুনা এক্সপ্রেস ও চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের মাঝে পড়ে ও ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারান চারজন। গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা করা আরও চারজনকে। এর পর কিছুটা নড়েচড়ে বসে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলপুলিশ, ঢাকা মহানগর পুলিশকে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রেললাইনের ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা, বাজার, দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদে বন্ধ হয়ে যায় কারওয়ান বাজার রেললাইনের মাছ বাজারটি। কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতেই ২০১৭ সাল থেকে আবারও সেখানে বসেছে মাছের বাজার। গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়। মগবাজার উড়াল সেতু চালু হলেও কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ে এখনো প্রতিদিন তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট।
কারওয়ান বাজার ট্রাকস্ট্যান্ড রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান মো. রেজাউল প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেন আসার আগে স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সংকেত দেওয়া হয় দুই-তিন মিনিট আগে। একটি ট্রেন পার হওয়ার জন্য তিন মিনিটের জন্য প্রতিবন্ধকগুলো ফেলা হয়। ওই সময় সবার মধ্যে তাড়াহুড়া যেন বেড়ে যায়। এ জন্য জটলা বেঁধে যায়। এই জটলার কারণে যানজটের লাইন দীর্ঘ হয়। আরেকটি ট্রেন আসার সময় যেন দুর্ঘটনা না ঘটে, তাই অনেক সময় ১০ মিনিটেরও বেশি সময় ক্রসিং বার ফেলে রাখা ছাড়া উপায় থাকে না।
রেললাইনের ওপরেই বিভিন্ন স্থাপনা থাকায় ট্রেনকে চলতে হয় ধীর গতিতে। আশকোনার রেলক্রসিংয়ে চলমান সেই ট্রেনেই চলছ ওঠার চেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত
তবে রাজধানীর অনেক জায়গায় স্থানীয় এলাকাবাসী নিজেরাই চলাচলের জন্য রেললাইনের ওপর প্রায় অর্ধশত ক্রসিং বানিয়েছে বলে রেলপুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান। ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিবাগে ছোট ছোট গলির সঙ্গে পাঁচটি অবৈধ রেলক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। কুড়িল উড়াল সেতুর নিচেও নিয়ম না মেনে লোকজন চলাচল করে। মালিবাগ, মহাখালী, খিলক্ষেত ও কুড়িল এলাকায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। আমরা বিভিন্ন সময় সচেতনতার জন্য রেলস্টেশন ও আশপাশে মাইকিং করে থাকি। লিফলেটও বিতরণ করছি।’
বাড়ছে ট্রেনের সংখ্যা
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল সহজ করার লক্ষ্যে কাজ করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ঢাকা-মোহনগঞ্জ রুটে দুটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সোনার বাংলা ও চট্টলা এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে আশপাশের এলাকায় একাধিক কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে। রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকায় ১০টির মতো ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও একাধিক ট্রেন সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। এ জন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে ডবল রেললাইনের কাজ চলছে। এ ছাড়া আরেকটি আলাদা প্রকল্পের টঙ্গী-জয়দেবপুরে ডবল রেললাইন, ঢাকা-টঙ্গী রুটে চার লেনের কাজ খুব দ্রুতই শুরু হবে। এর পাশাপাশি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে আরও নতুন কয়েকটি ট্রেন সার্ভিস চালু হবে। এর ফলে ঢাকার রেলক্রসিংগুলো আরও দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকবে। এ অবস্থায় কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করাচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো রেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে ওভারপাস বা উড়াল সড়ক নির্মাণ করা যেতে পারে সে জন্য কাজ করা হচ্ছে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে এই প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
উড়াল রেল সড়ক নির্মাণের পরামর্শ
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা উড়াল সড়ক বা ওভারপাস নির্মাণের। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের রেলক্রসিংয়ের ওপর উড়াল সড়ক নির্মাণ হলে যানজট না কমে আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, রেলটাকে আলাদা করতে হবে রাস্তা থেকে। আমরা এখন উড়াল সড়ক বানিয়ে রাস্তাকে আলাদা করছি। খিলগাঁওয়ে উড়াল সড়ক নির্মাণ করে এখন নিচে যানজট থাকে, ওপরে থাকে। উড়াল সড়ক না বানিয়ে উড়াল রেল সড়ক তৈরি করতে হবে অনেকটা মেট্রোরেলের মতো করে উড়াল রেল সেতু নির্মাণ করা প্রয়োজন।