দক্ষিণ কোরিয়ার গোলরক্ষক জো’কেই রাশিয়া বিশ্বকাপের বড় ঘটনাটির নায়ক বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক। এককালে যিনি নিজেই এশিয়ার অন্যতম সেরা গোলরক্ষক ছিলেন। আমিনুল বলেন, মাঠের খেলায় যোগ্যতর দল হিসেবেই জিতেছে দক্ষিণ কোরিয়া। আর এশিয়ার প্রতিনিধি তেগুক ওয়ারিয়ার্সদের পায়েই ঘটল সবচেয়ে বড় অঘটন। এই জয় বিশ্বফুটবলের কোটি কোটি সমর্থকের হৃদয় ভাঙলেও এশিয়াকে করেছে গৌরবান্বিত। অন্যদিকে নিজেদের শেষ ম্যাচে পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে নকআউট পর্বে উঠলেও ব্রাজিল সমর্থক হিসেবে আমিনুলকে ক্ষুব্ধ করেছে ব্রাজিলের ছন্নছাড়া ফুটবল।হতাশ করেছে সেলেকাওদের আক্রমণভাগের গোলখরা।
আমিনুল বলেন, বাংলাদেশ সময় বুধবার সন্ধ্যায় চলতি বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনের সাক্ষী হলো কাজান এরিনা স্টেডিয়াম। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ‘দ্য মেশিন’ খ্যাত টিম জার্মানিকে হারিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। অথচ রাশিয়া বিশ্বকাপে ফুটবলপ্রেমীরা এই টিমটির ওপরই রেখেছিল সবচেয়ে বেশি আস্থা। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচের বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। অপ্রত্যাশিতভাবেই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় হয়েছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের। মুলারদের খেলা দেখে মনেই হয়নি তারা বিশ্বকাপ জিততে গেছে রাশিয়ায়। খেলোয়াড়রা দলগতভাবে ছিল ছন্নছাড়া আর ব্যক্তিগতভাবে নিষপ্রভ। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়াকে জিতিয়েছে তাদের লড়াকু মনোভাব। জার্মানির আক্রমণগুলো অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে রুখে দিয়েছেন একজন জো। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এশিয়ার সবচেয়ে সফল দল কোরিয়া বিশ্বকাপের সবশেষ মুখোমুখি লড়াইয়ের জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল ২০০২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। আমিনুল বলেন, এ জয়ের মাধ্যমে কোরিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে না পারলেও থামিয়ে দিয়েছে জার্মানির অগ্রযাত্রা। জার্মানির পরাজয়ে বিশ্বকাপের রঙ কিছুটা ফিকে হলেও এ জয় এশিয়ার জন্য গৌরবের। তিনি বলেন, এবারের বিশ্বকাপে রঙধনুর সাতরঙের মধ্যে নীল (ইতালী) ও কমলার (হল্যান্ড) অনুপস্থিতি অনুভব করছে সারাবিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা। জার্মানির অনাকাঙিক্ষত বিদায়ে চলতি বিশ্বকাপের মঞ্চে অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে ইউরোপের প্রভাব।
ব্রাজিল অপরাজিত থেকে নকআউট পর্বে উঠলেও তাদের খেলা মন ভরাতে পারেনি আমিনুলের। সেলেকাওদের একনিষ্ঠ সমর্থক এ গোলরক্ষক বলেন, পেন্টাজয়ী দলটির সমর্থক সংখ্যা যেমন অগুনতি, প্রত্যাশাও তাই অনেক বেশি। বিশ্বকাপে তাদের যাত্রা প্রত্যাশিত হয়নি। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচটির আগে অনিশ্চয়তার ক্ষীণ একটি রেখা ছিল তাদের সামনে। সমন্বিত ফুটবল খেলে সে শঙ্কা কাটিয়েছে ঠিকই খেলা কিন্তু মন ভরাতে পারেনি। ম্যাচের ৮০-৮০ মিনিট পর্যন্ত সময়টুকু ব্রাজিল তাদের ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিল। এ সময় অঘটন ঘটে যেতে পারতো। ব্রাজিলের অলআউটের বিপরীতে কাউন্টার অ্যাটাকে গিয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল সার্বিয়া। আলিসন-থিয়াগো ও মিরান্ডা শেষ মুহূর্তের প্রচেষ্টায় ইউরোপের হোয়াইট ঈগলদের অন্তত দুইটি নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে দিয়েছেন। ব্রাজিল দল যেন আগামীতে কোনো ম্যাচকে এরকম ছন্নছাড়া করে না তোলে। আমিনুল বলেন, ব্রাজিলের ম্যাচের ভালো দিক হচ্ছে- চোট আক্রান্ত মার্সেলোর অনুপস্থিতি, কাসেমিরার নিষপ্রভতা ও নেইমার বোতলবন্দি থাকায় ব্রাজিল যখন মাঠের বামপ্রান্ত দিয়ে আক্রমণ গড়ে তুলতে পারছিল না তখন কার্যকর হয়ে উঠেছে তাদের ডানপ্রাপ্ত। পাউলিনহো, কুটিনহো ও উইলিয়ান মিলে জ্বলে উঠেছেন টিমওয়ার্কে। এ ম্যাচে নেইমার প্রথম দুই ম্যাচের চেয়ে অনেকটাই খোলসমুক্ত হয়েছেন। আর ব্রাজিলের নেতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে- ব্রাজিলের অ্যাটাকাররা গোল পাচ্ছেন না। জেসুস এখনও গোলের খাতাই খুলতে পারেনি। নেইমার সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যতগুলো ক্লোজ সুযোগ মিস করেছে তা তার মতো সুপার স্টারের কাছে অপ্রত্যাশিত। আক্রমণভাগের এ গোলখরা পরের ম্যাচে ব্রাজিলকে ভোগাতে পারে। বুধবারের অন্য ম্যাচগুলোর পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমিনুল বলেন, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে দুইবার পিছিয়ে পড়েও কোস্টারিকার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে। তবে হতাশ করেছে মেক্সিকোর খেলা। প্রথম দুই ম্যাচ ভালো করে প্রত্যাশার পারদ ঊর্ধ্বমুখী করে তোলা মেক্সিকোকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে সুইডেন। গ্রুপে যে সুইডেন সবচেয়ে অনালোচিত ছিল তারাই হয়েছে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। আমিনুল বলেন, রাশিয়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে লক্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে অপেক্ষাকৃত নবীন ও খর্ব শক্তির দলগুলো ছেড়ে কথা বলেনি শক্তিমানদের। ফেভারিটদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা। এটা ফুটবলের জন্য ইতিবাচক একটি লক্ষণ।
বৃহস্পতিবারের ম্যাচগুলোর পেডিকশন করতে গিয়ে আমিনুল বলেন, ব্লু সামুরাই জাপানের সঙ্গে পোল্যান্ডের র্যাঙ্কিংয়ে দূরত্ব যোজন যোজন। তবে খেলার মানের দূরত্ব বেশি নয়। চার পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষ থেকে ম্যাচটি শুরু করবে তারা। প্রথম দুই ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে ঘুরে দাঁড়ানো জাপান এ ম্যাচে স্পষ্টতই ফেভারিট। এশিয়ার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে জাপানকে এ ম্যাচ জিততেই হবে। অন্যদিকে আফ্রিকান ত্রিরাঙ্গা সিংহ সেনেগালের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে কফি চাষিরা (লা ক্যাফেতেরোস)। হামেস রদ্রিগেজ ও ফ্যালকাওদের দল কলম্বিয়া আমার দৃষ্টিতে বেটার এবং ফেভারিট। তবুও প্রত্যাশা করব, দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রতিনিধিত্ব করুক এশিয়া ও আফ্রিকার দুইটি দেশ জাপান-সেনেগাল।
অনুলিখন: কাফি কামাল