বাসার ভেতরে শিশু খুন হচ্ছে। ছিনতাইকারীর হাতে রাস্তায় প্রাণ যাচ্ছে। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হচ্ছে। তুচ্ছ ঝগড়া থেকে দলাদলি, সংঘাত , মারামারি, ছুরিকাঘাতে খুনোখুনি ঘটছে প্রতিদিন। ক্রমেই খুনের নগরীতে পরিণত হচ্ছে চট্টগ্রাম। গত ঈদুল ফিতরের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে ২৭ জুন সকাল পর্যন্ত ১২ দিনে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সাতটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।এর মধ্যে রয়েছে ৯ মাসের শিশু কন্যা।
সর্বশেষ ২৭ জুন সকালে খুন হয় মেরন যান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ইনহাস (১২)। নগরীর বাকলিয়া এলাকার নিজ বাসভবনের ৬ তলার বাসা থেকে গলা কাটা ইনহাসকে উদ্ধার করে স্বজনরা। এর আগে মঙ্গলবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানার আতুড়ার ডিপো এলাকায় বন্ধুর ছুরিকাঘাতে খুন হয় সাইদুল ইসলাম অনিক (২০)। এ ঘটনায় ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে নিহত অনিকের আরেক বন্ধু সম্রাট।
ঈদের আগের দিন ১৫ জুন বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গায় মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বালতির পানিতে চুবিয়ে নির্মমভাবে খুন করা হয় ৯ বছরের শিশু নিঝুম মিত্র তরীকে। এ সময় খুনিরা নিয়ে যায় কিছু স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ২০ হাজার টাকাও।
ঈদের পরদিন খুন হন আবু জাফর অনিক (২৬) নামের এক যুবক। ছোট ভাইয়ের মোটরসাইকেলের হর্ন বাজানোকে কেন্দ্র করে তর্কাতর্কির পর অনিককে ছুরিকাঘাতে খুন করে নগর ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। এ ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই এখন পুলিশের কব্জায়।
এ ছাড়া একইদিন সন্ধ্যায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন দিনমজুর কিশোর মো. সুমন (১৬)। এর পরের দিন সোমবার রাতে খুন হন মো. জসিম উদ্দিন (২২) নামে আরেক যুবক। এভাবে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রামে। অথচ এসব ঘটনার বেশির ভাগের রহস্যই উদঘাটন করতে পারছে না পুলিশ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঈদের আগের দিন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত মাত্র ১২ দিনে ৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে মে মাসে ৪টি, এপ্রিল মাসে দুটি, মার্চ মাসে তিনটি, ফেব্রুয়ারি মাসে ২টি, জানুয়ারি মাসে ৪টি খুনের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে ঘটে ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার সবকিছুর সঙ্গে জড়িত কিশোর অপরাধীরা। যাদের মাথার উপর রয়েছে রাজনীতিক বড় ভাইদের ছাতা। এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, নারী ঘটিত বিষয়, ছিনতাইয়ের বিষয়ও রয়েছে। যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
এছাড়া ২০১৭ সালের ৬ই অক্টোবর নগরীর নালাপাড়ায় নিজ বাসার সামনে খুন হন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সমপাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ কর্মী মোকতারের স্বীকারোক্তিতে প্রথম উঠে আসে খুনের নির্দেশদাতা হিসেবে এক বড় ভাইয়ের কথা।
২০১৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে ডা. খাস্তগীর স্কুলের সামনে স্কুলছাত্র আদনান ইসফার (১৫) ছুরিকাঘাতে খুন হন। এই ঘটনায় পাঁচ কিশোরকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে তথ্য আসে-হত্যাকারীদের বড় ভাই আব্দুর রউফ নামে চকবাজার ওয়ার্ডের এক আওয়ামী লীগ নেতার নাম।
গত ২রা মে সকালে পতেঙ্গায় ন্যাভাল একাডেমির অদূরে ১৮ নম্বর ঘাট এলাকায় তাসফিয়া আমিন নামে এক স্কুলছাত্রীর মরদেহ পায় পুলিশ। তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলার ছয় আসামির মধ্যে চারজনই কিশোর। মামলার আরেক আসামি তাদের কথিত বড় ভাই যুবলীগ নেতা মো. ফিরোজ।
২৮শে মে চট্টগ্রাম নগরীর সল্টগোলায় নিজ বাসায় ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দীকে নিজ বাসায় গলা কেটে খুন করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তিন কিশোর সজলের ছেলের বন্ধু।
ঈদুল ফিতরের পরদিন ১৭ জুন গভীর রাতে নগরীর হালিশহরে খুন হন মো. সুমন (২০) নামে এক গ্যারেজ কর্মী। এই ঘটনায় জড়িত ১০ কিশোরকে নগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে। যারা ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত।
একইদিন নগরীর দামপাড়ায় আবু জাফর অনিক (২৬) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। অনিকের ছোট ভাই কিশোর বয়সী রনির সঙ্গে একই পাড়ার সমবয়সী ছাত্রলীগ নামধারীদের সাথে ঝগড়ার জেরে খুন হন অনিক।
খুনে জড়িতদের বড় ভাই হিসেবে নাম এসেছে মো. মহিনউদ্দিন তুষার নামে এক যুবলীগ নেতার। খুনের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়া তুষারকে সেদেশের পুলিশ আটক করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পর পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।
ঈদের চারদিন আগে নগরীর সার্সন রোডে একটি রেস্টুরেন্টে সমবয়সী বন্ধুর হাতে ছুরিকাঘাতের শিকার হন আইমান জিহাদ নামে এক কিশোর। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তাকে ছুরিকাঘাত করা কিশোরকে ব্যাগ থেকে ছোরা বের করে দিচ্ছে তার সমবয়সী বান্ধবী।
আর ২৬ জুন রাতে নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় সাইদুল ইসলাম অনিক খুনে জড়িতদের বড় ভাই হিসেবে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম বলেছেন স্বজনেরা।