ম্যাচের পুরোটাজুড়ে থাকল ব্রাজিলের আধিপত্য। বল দখলের লড়াই থেকে শুরু করে আক্রমণ সাজানোয় দাপট দেখিয়ে গেল সেলেসাওরাই। কিন্তু সুযোগ বুঝে পাল্টা আক্রমণ করা বেলজিয়াম করে দেখাল আসল কাজ। প্রথম গোলটি উপহার হিসেবে পাওয়া বেলজিয়াম দ্বিতীয় গোলটি আদায় করে নিল নান্দনিক ফুটবলের পসরা সাজিয়ে। তাতে ব্যবধান বাড়ল, মিলে গেল শেষ চারের টিকেট। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে উঠল বেলজিয়াম।
রোমেলু লুকাকু, এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনেদের নিয়ে গড়া এই বেলজিয়ামের বিপক্ষে ব্রাজিলের লড়াইটা কঠিন হবে, সেটা অনুমেয়ই ছিল। কিন্তু রাশিয়ার কাজান এরিনাতে ম্যাচের শুরু থেকেই দাপট দেখিয়ে খেলতে থাকেন নেইমার, কোটিনহো, উইলিয়ান, জেসুসরা।
অবশ্য দাপটগুলো গোলে পরিণত করতে পারেননি তারা। সঙ্গে বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবাউট কর্টোইস হয়ে উঠেছিলেন চীনের প্রাচীর। ১৯৬৬ সালের পর নিজের দেশকে সেমি ফাইনালে তোলার লড়াইয়ে ব্রাজিলের বেশ কয়েকটি আক্রমণ ভন্ডুল করে দেন তিনি।
বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে বেলজিয়ামের এটা প্রথম জয়। এরআগের একমাত্র সাক্ষাতে হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল তাদের। ২০০২ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিয়েছিল বেলজিয়াম। এবার আরেকটু পথ এগিয়ে ব্রাজিলকে বাড়ি যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল তারা।
রাশিয়া বিশ্বকাপের ভেন্যু কাজান এরিনা যেন রাঘব বোয়ালদের বিদায় জানাতেই বেশি পছন্দ করে। এই মাঠেই বিদায় হয়েছে জার্মানি ও আর্জেন্টিনার। এবার ব্রাজিলও হাঁটল সেই পথে।
একটু বেশিই গোলক্ষুধা নিয়ে মাঠে নেমেছিল ব্রাজিল। খেলা শুরু হতেই আক্রমণ সাজাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সেলেসাওরা। যদিও ম্যাচের দুই মিনিটে বেলজিয়ান মিডফিল্ডার কেভেন ডি ব্রুইনে ব্রাজিলের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। বল পেয়েই গোলে শট নেন ব্রুইনে। কিন্তু তার শট গোলপোস্ট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। পরের মিনিটে ব্রাজিল পাল্টা আক্রমণ করলেও সুবিধা করতে পারেনি।
ম্যাচের আট মিনিটে যেন ভাগ্য মুখ ফিরিয়ে নেয় ব্রাজিলের দিক থেকে। থিয়াগো সিলভার হেড গোলবারে লেগে ফিরে আসে। দুই মিনিট পরে আবারও ব্রাজিলের হানা। কিন্তু বেলজিয়ামের ডি বক্সে জটলা বেধে যাওয়ায় গোল আদায় করতে পারেনি ব্রাজিল। শুরু থেকেই ক্ষীপ্রতার সঙ্গে খেলে আসা ব্রাজিল শিবিরে ১৩ মিনিটে নেমে আসে চরম হতাশা। বেলজিয়ামের কর্নার কিক ফেরাতে গিয়ে নিজেদের জালেই বল জড়িয়ে দেন কাসেমিরোর জায়গায় এই ম্যাচ খেলতে নামা ফার্নান্দিনহো।
পিছিয়ে পড়ে আরও খেপে ওঠে সেলেসাওরা। ১৫ থেকে ১৯ মিনিট পর্যন্ত তিনটি আক্রমণ করে তারা। কিন্তু বেলজিয়ামের রক্ষণভাগকে পরাস্থ করে জালের ঠিকানা করে নিতে পারেননি নেইমার, কোটিনহো, উইলিয়ানরা। ব্রাজিলের কয়েকটি আক্রমণ ফিরিয়ে হানা দিতে শুরু করে বেলজিয়ামও। ২১ ও ২৩ মিনিটে দুটি আক্রমণ করে তারা। প্রথম আক্রমণে এডেন হ্যাজার্ডের দারুণ ড্রিবলিংয়ে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ ধোঁকাই খেয়েছে। তবে এ যাত্রায় রক্ষা পায় ব্রাজিল।
আক্রমণগুলোকে শেষ পরিণতি দিতে না পারলেও দুই দলই অসাধারণ ফুটবল খেলছিল। যাকে বলা যায় ধুন্ধুমার লড়াই। বল এখন বেলজিয়ামের ডি বক্সে তো চোখের পলকেই চলে গেছে ব্রাজিলের বিপদ সীমানায়। ২৬ মিনিটে মার্সেলোর দূরপাল্লার শট ফেরান বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিবাউট কর্টোইস।
২৯ মিনিটে গিয়ে বেলজিয়ামকে চেপে ধরে ব্রাজিল। একের পর এক আক্রমণ সাজাতে থাকে তারা। এরই এক ফাঁকে বল পেয়ে ক্ষীপ্র গতিতে ছোটেন বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। সামনে পেয়ে যান ডি ব্রুইনেকে। লুকাকুর পাস থেকে বল পেয়ে দারুণ শটে গোল করে বেলজিয়ামকে এগিয়ে নেন ডি ব্রুইনে।
৩১ মিনিটের মধ্যেই ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে ব্রাজিল সেভাবে আর আক্রমণ করতে পারেনি। আক্রমণ করলেও কিছু নেইমার-কোটিনহোরা মিস করেছেন আর কিছু আক্রমণ ফিরিয়ে দিয়েছেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক কর্টোইস। কোটিনহো, মার্সেলো, জেজুসদের নেওয়া বেশ কয়েকটি শট দারুণ দক্ষতায় ফিরিয়ে প্রথমার্ধে নিজেদের জাল অক্ষত রাখেন চেলসির হয়ে ক্লাব ফুটবল খেলা এই গোলরক্ষক।
বিরতি থেকে ফিরে আক্রমণের পরিমাণ আরও বাড়ায় ব্রাজিল। কিন্তু অবিরত আক্রমণের পরও গোলের দেখা নেই তো নেই-ই। উল্টো ৬২ মিনিটে ডি ব্রুইনের পাস থেকে বল পেয়ে বাম পাশ ঘেঁষে ছোটেন হ্যাজার্ড। ঢুকে পড়েন ব্রাজিলের ডি বক্সেও। যদিও তার নেয়া বা পায়ের শট একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কয়েক সেকেন্ড পর ডগলাস কস্তার দারুণ শট ফিরিয়ে দেন কর্টোইস। ৭৫ মিনিটে আবারও শট হাঁকান কস্তা। এবারও কর্টোইস বাধায় তার চেষ্টা বিফলে যায়।
কিছুক্ষণ আগেই পলিনহোর বদলি হিসেবে মাঠে নেমেছেন রেনাটো অগাস্টো। আর মাঠে নেমেই তার বাজিমাত। কোটিনহোর ক্রসে মাথা গুঁজে গোল আদায় করে নেন তিনি। তাতে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্বপ্ন কিছুটা হলেও সতেজ হয়। এরপর গোলের খোঁজে একের পর এক আক্রমণ করে গেছে ব্রাজিল।
৮৫ মিনিটে সহজ সুযোগ মিস করেন কোটিনহো। ৯৪ মিনিটে নেইমারের অসাধারণ শট ফেরান পুরো ম্যাচে ব্রাজিলের সামনে বাধার দেয়ার তুলে দাঁড়িয়ে থাকা কর্টোইস। এরপর আর গোলের দেখা পায়নি ব্রাজিল। ২-১ গোলের হার নিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শেষ করতে হয় নেইমার, কোটিনহো, পলিনহোদের।