অভাবনীয়। বিস্ময়কর। বাংলাদেশ কেন? পৃথিবীর ইতিহাসেই কী কখনো এমন ঘটনা ঘটেছে? নিষ্পাপ, নির্দলীয়। রাজপথে হাজার-হাজার শিশু-কিশোর। বুক তাদের বাংলাদেশের হৃদয়। মুখে স্লোগান। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। ইনসাফের দাবি নিয়ে এসেছে ওরা। তার চেয়ে বড় কথা ওরা আমাদের, বড়দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই রাষ্ট্র, সমাজে কীভাবে পচন ধরেছে। আমরা হয়তো জানতাম। কিন্তু অতটা কখনোই নয়। এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানরা সব আইনের ঊর্ধ্বে। তাদের কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না। না, কোনো কিছুতেই নয়। সম্ভবত প্রথম একটি শিশুর দীপ্ত উচ্চারণ ফেসবুকে ভাইরাল হয়। লাইসেন্স আছে। না, নেই। তাহলে এই গাড়ি যাবে না। এরপর শুরু হয়েছে নতুন এই সংস্কৃতি। এই শিশুরাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে রাজপথ।
শুরু হয়েছিল মর্মন্তুদ দুটি মৃত্যুকে ঘিরে। দুই শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলা হয় বাসচাপায়। বাংলাদেশে অবশ্য এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বাসচালকরা বরাবরই বেপরোয়া। তাদের ওপরে রয়েছে ক্ষমতাবানদের বিশাল ছায়া। পুরো পরিবহন সেক্টরই মাফিয়াতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে। এবারের ভিলেন জাবালে নূর পরিবহনের মালিকানায়ও রয়েছে ক্ষমতাতন্ত্রের স্পষ্ট সংযোগ। দুই বন্ধুর নিষ্ঠুর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজপথে নেমে আসে তারা। এরই মধ্যে ক্ষমতাবান এক মন্ত্রীর বক্র হাসি আন্দোলনকারীদের আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান মন্ত্রীর নিষ্ঠুরতা দেখে। একে একে আন্দোলনে যোগ দেয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা কৌশল আর উদ্যোগ নেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। শাসক দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে, এ আন্দোলনে স্বার্থান্বেষী বিরোধী মহল ইন্ধন যোগাচ্ছে। আন্দোলনে যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে বলেও সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্যও বারবার বলা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বন্ধ ছিল দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষার্থীদের উত্তাঙ্গ ঢেউ তাতে কমেনি, বরং আরো বেড়েছে। এ দিন ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে। রাজধানী শহর ছিল অচল। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়। অবরোধে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। তবে তারা তা মেনে নিয়েছেন হাসি মুখেই। এ আন্দোলনের পরিণতি যা-ই হোক না কেন, এই শিশুরা এরই মধ্যে রচনা করেছে নতুন ইতিহাস। তাদের কিছু কিছু দাবি আর স্লোগান নতুন চিন্তা আর নতুন এক বাংলাদেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। এই প্ল্যাকার্ড জন্ম দিয়েছে বিপুল আলোচনার। জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিন দিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে- এ দাবি বড়রা তোলার হিম্মত না পেলেও এই শিশুরা-কিশোররা সে সাহস দেখিয়েছে।
যন্ত্রটি অবিরাম চলছে। স্বাধীনতার পর তা কোনো দিনই বন্ধ হয়নি। নাম দেয়া হয়েছে ষড়যন্ত্র। শাসকেরা এ যন্ত্র খুঁজতে খুবই ভালোবাসেন। কখনো তা সত্য হয়, কখনো মিথ্যা। শিশু-কিশোরদের অভাবনীয় এ আন্দোলন ঘিরেও কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার হয়েছে। তার সত্য-মিথ্যা হয়তো কোনো দিন জানা যাবে অথবা জানা যাবে না। কিন্তু এই সত্য সম্ভবত, কেউ অস্বীকার করবেন না; এই আন্দোলনের প্রায় শতভাগ মুখই নিষ্পাপ। তাদের আমরা ভাবতাম ফেসবুক প্রজন্ম। কিন্তু তারা দেখিয়েছে অসীম সাহস, তারা ত্যাগ স্বীকার করতে জানে। পচতে বসা সমাজের পতন ঠেকানোর এক ঐতিহাসিক শক্তি তাদের মধ্যে রয়েছে। মন্ত্রী, সচিব, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিক সমাজের প্রভাবশালী একটি বড় অংশ যেকোনো আইনের তোয়াক্কা করেন না, আইনি ব্যবস্থা যে এখানে বহুলাংশে ভেঙে পড়েছে এই শিশুরা আমাদের সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। না, তাদের কোনো নেতা নেই, কোনো দল নেই। তারা অবিচল, তারা নিষ্কম্প। তারাই আগামী দিনের বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্রের মেরামত আসলেই জরুরি। আসুন, ওদের কথা শুনি। এতে কোনো ক্ষতি নেই।
এদিকে অবরোধ-বিক্ষোভে গতকালও অচল ছিল ঢাকা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয়েছে সারা দেশে। টানা কর্মসূচি চলার মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। তারা বাস বন্ধে নিরাপত্তার কথা বললেও শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে দূরপাল্লার কোনো বাসে হামলা করেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। এদিকে রাজধানীতেও গণপরিবহন চলেনি। বড় ধরনের বিক্ষোভের আশঙ্কায় গতকাল সরকারি ঘোষণায় সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তবে বিক্ষোভে আগের দিনের চেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। পুরো রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কের মোড়ে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কাজ করে। তারা নিজেদের মতো করে যানবাহনকে সারিবদ্ধভাবে লেন ধরে চলতে বাধ্য করে।
এমনকি রিকশা চালকদেরও সারিবদ্ধ হয়ে চলতে দেখা যায় সড়কে। এ ছাড়া মোড়ে মোড়ে সব ধরনের যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীরা। পঞ্চম দিনে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও গাড়ির কাগজপত্র না থাকায় আটকে দেয় শিক্ষার্থীরা। যানবাহনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে শিক্ষার্থীদের চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। পরিবহন না থাকায় রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ হেঁটে, রিকশায় বা বিকল্প যানে দুর্ভোগ সঙ্গী করে চলাচল করলেও এতটুকু বিরক্তি ছিল না কারও। সাধারণ মানুষ বলছেন দুর্ভোগ সহ্য করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরলে এটি হবে দেশের জন্য একটি বড় অর্জন। এদিকে শিক্ষার্থীদের তল্লাশিতে সরকারি যানবাহনের কাগজপত্র ও লাইসেন্স না থাকার বিষয় ধরা পড়া এবং তা ব্যাপক হারে প্রচার হওয়ায় গতকাল সরকারের পক্ষ থেকে গাড়িতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মৌখিকভাবে এ নির্দেশনা দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও স্কুল বা কলেজের পোশাক এবং পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। তারা কেউ কেউ জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ সড়কে নেমে যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করছিলেন। কেউ যানবাহনকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চলতে সহযোগিতা করেন। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিকাল পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করেন। দিনের কর্মসূচি শেষে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে। এদিকে সরকারের তরফে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। রাস্তা ছেড়ে ক্লাশে ফিরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকেই একই ধরনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
শাহবাগ থেকে ফার্মগেট: সকাল ১১টায় বৃষ্টি উপেক্ষা করে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা পঞ্চম দিনের মতো প্রধান সড়ক অবরোধ করে। যানবাহন আটকিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে তারা। লাইসেন্সবিহীন চালকদের আটকে রেখে ট্রাফিক সার্জেন্টদের কাছে সোপর্দ করেন। গতকাল শাহবাগ মোড়ে অন্তত অর্ধশতাধিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন। সকাল থেকে বৃষ্টি থাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকলেও বৃষ্টি থামার পরপরই নগরীর বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ঢল নামে।
শাহবাগ মোড়ে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল ইডেন মহিলা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, ন্যাশনাল মহিলা কলেজ, সলিমুল্লাহ কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, টিএনটি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, টিএনটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয়, তেজগাঁও মহিলা কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, টিএনটি মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, বিএফ শাহিন কলেজ, তেজগাঁও ইউনিভার্সিটি কলেজ, সিটি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নবাবপুর সরকারি কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, দনিয়া কলেজ, সাউদার্ন সিটি কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ওয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা পলিটেকনিক, আদমজি হাবিবুল বাশার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাভার কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজ, শহীদ বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি কলেজ, ঢাকা নার্সিং কলেজ, নটরডেম কলেজ, মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ কলেজ, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, সেন্ট জোসেফ, ন্যাশনাল পলিটেকনিক, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, কেন্দ্রীয় মোহাম্মদপুর কলেজসহ আরো বেশকিছু কলেজের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি আদায়ের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করতে এসেছিলেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ অনেকে।
অবরোধে আসা শিক্ষার্থীরা এ সময় নানা স্লোগান দিতে থাকেন ‘রাস্তা বন্ধ রাষ্ট্রের মেরামত চলছে’ ‘সড়ক কেন মৃত্যু ফাঁদ’ ‘বিচার চাই-বিচার চাই ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ ‘আমার ভাই কবরে খুনিরা কেন বাহিরে’ ‘আমার বোন কবরে খুনিরা কেন বাহিরে’ ‘পুলিশ-ছাত্র ভাই ভাই ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ ‘ছাত্র-সাংবাদিক ভাই ভাই নিরাপদ সড়ক চাই’ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ‘উই মাস্ট গেট জাস্টিস’ ‘এবার তোরা মানুষ হ’ ‘শিক্ষকের হাতে বেত নাই পুলিশের কেন মার খাই’-এসব স্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত ছিল। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে শাহবাগ থেকে কাওরানবাজার, মৎস্যভবন, কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে ওই এলাকা দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। তবে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সকে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই চলাচলে সহযোগিতা করেন। এর বাইরে যে কয়টি মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করেছে সেগুলোর চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ছাড়ে।
যাদের কাছে বৈধ লাইসেন্স ছিল তাদের বেলায় কোনো সমস্যা হয়নি তবে যাদের কাছে লাইসেন্স ছিল না তাদেরকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কাউকে ঘণ্টাখানেক সময় আটকে রাখা হয়। আবার অনেককে সার্জেন্ট ডেকে এনে মামলা নিয়ে যেতে হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে পুলিশ সদস্যদের বহনকারী ভ্যান, বিজিবির পণ্য বহনকারী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গাড়িকে। বৃষ্টি থামার পরপরই মৎস্যভবন এলাকা থেকে পুলিশের একটি ভ্যান গাড়ি শাহবাগ মোড়ের দিকে আসে। তখন সেই ভ্যানটিকে ঘিরে ধরে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চান শিক্ষার্থীরা। তখন দেখা যায় চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে তিন মাস আগে। প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষার্থী ওই চালককে ঘিরে ধরলে সেখানে ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা উপস্থিত হন। তখন শিক্ষার্থীরা মামলা চাই-মামলা চাই বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
ট্রাফিক সার্জেন্ট ইমাম ওই চালককে ২০০ টাকার একটি মামলা দেন। দুপুরের দিকে বারডেম হাসপাতালের সামনের সড়ক দিয়ে শাহবাগ চত্বরের দিকে আসতে থাকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পণ্য পরিবহনের একটি গাড়ি। শিক্ষার্থীরা তখন ওই গাড়িটিকে ঘিরে ধরে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চায়। চালকের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় বিপাকে পড়তে হয় ওই চালক ও গাড়িতে বসা বিজিবির অন্য সদস্যদের। মামলা চাই মামলা চাই বলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকে। একইভাবে বিকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কার শিক্ষার্থীদের তোপের মধ্যে পড়ে। শিক্ষার্থীরা ওই গাড়ির বডিতে মার্কারস্প্রে দিয়ে লাইসেন্স নাই লিখে দিয়ে ঘণ্টাখানেক আটকে রেখে দেয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন মোটরসাইকেল চালকদেরও তোপের মুখে পড়তে হয়। অবরোধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি অনেক রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে শিক্ষার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে তা ব্যবস্থা করে দেন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন দুপুরের দিকে দুর্বৃত্তরা তাদের অবরোধের মধ্যে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। দুর্বৃত্তরা বিকালে বিআরটিসির একটি দুতলা বাস ভাঙচুর করেছে বলেও কিছু শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন। বিকাল চারটার দিকে শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান। পরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। আগামীকাল সকাল থেকে আবারো তারা জড়ো হওয়ার কথা জানান। শাহবাগ ছাড়াও কাঁটাবন মোড়, বাংলামোটর, ফার্মগেট এলাকায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করেন। প্রধান সড়ক আটকে আন্দোলন করায় যানবাহন চলাচল করতে পারেনি।
ডেমরা-যাত্রাবাড়ী-চিটাগাং রোড: সকাল ১০টা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় অবস্থান নেন ডেমরা, যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর আগে স্থানীয় হাজী হোসাইন প্লাজা মার্কেটের সামনে সমাবেশ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা সড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী ট্রাক, বাস, লেগুনাসহ বিভিন্ন যানবাহনের কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না তা তদারক করেন। একপর্যায়ে ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়ক, ডেমরা টু রামপুরা ব্রিজ লিংক রোডসহ আশপাশের সকল সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা সড়কের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে নানা স্লোগান দেয়।
অনেকের হাতে ছিল ব্যানার। সেখানে লেখা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’, ‘মাগো তোমার ছেলে রাজপথে, দাবি শুধু ৯টি’, ‘আমাদের ৯ দফা দাবি মানতে হবে’। পুরো সময়টিতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানান। তবে, শিক্ষার্থীরা জানান, তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ সময় এই সড়ক দিয়ে কিছু যানবাহন চলাচলের চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে চালকেরা উল্টোপথে ফেরত যেতে বাধ্য হয়। তবে, তাদেরকেও লাইলেন্স দেখিয়ে তবেই পার পেতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ বারবার শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে সরে যেতে অনুরোধ করতে থাকে।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে একটি বাস স্টাফ কোয়ার্টার থেকে যাত্রাবাড়ী অভিমুখে যেতে চাইলে তা আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ছাত্রদের কয়েকজন হ্যান্ড মাইকে কোনো ধরনের যানবাহন ভাঙচুর না করার আহ্বান জানান। তারা বলেন, তাদের আন্দোলন নিরাপদ সড়কের জন্য, যারা বেপরোয়াভাবে বাস চালিয়ে শিক্ষার্থীদের পিষ্ট করেছে তাদের বিচারের জন্য। কেউ যেন কোনো গাড়ি ভাঙচুর না করে। আর যদি কারো ড্রাইভিং লাইসেন্স বা গাড়ির কাগজপত্র না থাকে তাহলে তাকেও যেন কোনো আঘাত না করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।
বেলা ২টার পরে চিটাগাং রোড যাত্রাবাড়ী অভিমুখী সড়কে দেখা যায় তীব্র যানজট। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে শিক্ষার্থীরা এই সড়কের সানারপার, সাইনবোর্ড, যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থান নিয়ে যানবাহনের কাগজপত্র ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখেন। কেউ কেউ সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোলও করেছেন। চালকদের লাইসেন্স সঙ্গে নিয়ে সাবধানে গাড়ি চালানোর জন্য শিক্ষার্থীরা তাগাদা দিয়েছেন। যাত্রাবাড়ী মোড়েও ছিল প্রায় একই চিত্র। বৃষ্টির মধ্যেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন যানবাহনে কাগজপত্র ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না তা তদারকি করেন।
মিছিল-স্লোগানে উত্তাল ছিল বাড্ডা-রামপুরা: সকাল থেকেই রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে কুড়িল হয়ে আসা প্রগতি সরণির রাস্তাটিতে যানবাহনশূন্য ছিল। ১০টার কিছু পরেই নতুন বাজার এলাকায় ধীরে ধীরে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময় বনানী বিদ্যানিকেতন, গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাউথ পয়েন্ট স্কুলসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা নতুন বাজার এলাকার পুরো রাস্তাটিতে অবস্থান নেন। মিছিল স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে।
শুধু স্কুল কলেজ নয়, নতুন বাজারের পাশে ইউআইটিএস-এর শিক্ষার্থীরাও তাদের আন্দোলনে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা জানান, ছোট ছোট স্কুল কলেজের ছাত্ররা এই কয়দিন রাজপথে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের আন্দোলনের সঙ্গী হওয়াটা আমাদের অনেক আগেই উচিত ছিল। এই দাবিগুলো শুধু ওদের নয়। পুরো নগরবাসী আজ সড়কের এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির কাছে জিম্মি। দুপুর একটার দিকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পুরো রাস্তা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’, ‘আমার ভাই কবরে…খুনি কেন বাইরে’ এসব স্লোগানে মুখরিত নতুন বাজার শাহজাদপুর, সুবাস্তু নজর ভ্যালি উত্তরবাড্ডা, হোসেন মার্কেটসহ পুরো প্রগতি সরণি এলাকা। এর মাঝে দেখা যায়, বাঁশতলা রোড হয়ে আসা মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, বাস মিনি বাসসহ সব ধরনের যানবাহনের চালকও তাদের গাড়ির লাইসেন্স চেক করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। যে কয়টি যানবাহনের লাইসেন্স পায়নি সবক’টিই ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে সোপর্দ করেন তারা। এ সময় দায়িত্বরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার মোটরসাইকেলও আটক করেন। নতুনবাজার ক্যামব্রিয়ান কলেজের সামনে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে মোটরসাইকেল ও নিজেদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় মামলা দেয়া হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দেশের কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
সবাইকে আইনের আওতায় আসতে হবে। পুলিশের যদি গাড়ি লাইসেন্স না থাকে তাকেও লাইসেন্স করতে হবে। আইন সবার জন্য সমান। একই অবস্থা বাড্ডার লিংক রোডেও। এই অবরুদ্ধ করে রাখেন গুলশান কমার্স কলেজ ও ন্যাশনাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের দেখা যায়, রাস্তায় বেশকিছু যানবাহন আটকে রেখে আন্দোলন করছেন। কিছু সময় পরে দেখা যায় কলেজ দুটির শিক্ষার্থীরা সড়কের ওপর থেকে সরিয়ে সাধারণ পথচারীদের ফুটপাথে চলাফেরার জন্য অনুরোধ করেন। সবাইকে চলাচলে ফুটপাথ ব্যবহারে সচেতন করেন।
সাধারণ পথচারীরাও তাদের এই কাজটিকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, এটা ওদের করার কথা নয়। আমাদের সচেতন হওয়াটা আমাদেরই কাজ। আমরা আসলেই অনেক অনিয়ম করি। ওই এলাকায় কর্মসূচি চলে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত।
মহাখালী থেকে উত্তরা: সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মহাখালী আমতলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী মহাখালীর মোড়ে গিয়ে সড়কের মধ্যে বসে পড়েন। তারা অবিলম্বে নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। এ সময় তারা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে স্লোগান দিতে থাকে।
এ সময় শিক্ষার্থীরা সড়কে আটকে থাকা গাড়িগুলোর লাইসেন্স দেখতে চান। কাগজপত্র না থাকলে গাড়ি আটকে দেয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স, বিদেশগামী এবং হজযাত্রীদের গাড়িগুলো আন্দোলনকারীরা নিরাপদে ছেড়ে দেন। সেখানে নৌমন্ত্রীর কুশলিকাপত্ত দাহ করা হয়। সকাল ১০টায় উত্তরার জসীম উদদীন রোড থেকে শুরু করে হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত উত্তরার রাজউক মডেল কলেজ, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, স্কলাস্টিকা, উত্তরা কমার্স কলেজ ও খিলক্ষেত মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নেন।
সায়েন্সল্যাব-মিরপুর রোড: ধানমন্ডি এলাকার সায়েন্স ল্যাব-সিটি কলেজ মোড়, ধানমন্ডি-২৭ নম্বর মোড়, মানিক মিয়া এভিনিউ, জিগাতলা বাস স্ট্যান্ড, সংকরসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় ধানমন্ডি এলাকার প্রায় সব রাস্তায়ই যানবাহন শূন্য হয়ে পড়ে। হাতেগোনা কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা ছাড়া কিছুই চলতে দেখা যায়নি রাস্তায়। তবে যেই কয়টি ব্যক্তিগত গাড়ি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি, মোটরসাইকেল রাস্তায় নেমেছে, তার সব কয়টিরই লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখেছেন ছাত্ররা। কিছু কিছু জায়গায় গাড়ির কাগজ না থাকায় গাড়ির চাবি নিয়ে রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে রাখলেও বেশির ভাগ স্থানে পুলিশ সার্জেন্ট ডেকে মামলা করায় তারা। ল্যাব এইড হাসপাতালের অদূরে পুলিশের এক সার্জেন্টের মোটরসাইকেলের কাগজ দেখতে চান শিক্ষার্থীরা।
পোশাক পরিহত সার্জেন্ট কাগজ না দেখিয়ে উল্টো ছাত্রদের সঙ্গে তর্কে জড়ান। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা তার দিকে ছুটে যান। ঘটনার এক পর্যায়ে সার্জেন্ট দৌড়ে পালালে ছাত্ররা তার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আন্দোলনের শুরুতে কাগজ দেখাতে না পাড়ায় মিরপুর টু আজিমপুর চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের দুটি বাস, মেঘলা ট্রানসপোর্ট কোম্পানির একটি বাসে ভাঙচুর চালায় ছাত্ররা। আন্দোলন চলাকালে খামার বাড়ি মোড় থেকে শুরু করে নীল ক্ষেত মোড় পর্যন্ত পুরো রাস্তাটিই ছিল শিক্ষার্থীদের দখলে।