এবারের কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, অন্য বছরের মতো এবারো পোস্তায় কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু চামড়ার মূল ক্রেতারা এবার থাকবেন সাভারের নির্ধারিত ট্যানারি পল্লীতে। ফলে কাঁচা চামড়া বিক্রির জন্য পোস্তার ব্যবসায়ীদের যেতে হবে সাভারে। আবার ট্যানারি মালিকদেরও চামড়া কিনতে আসতে হবে পোস্তায়। এ কারণে চিন্তিত ব্যবসায়ীরা।এছাড়া গতবারের চামড়া এখনো মজুত রয়েছে। আগে চামড়া বেচাকেনা হাজারীবাগে হওয়ায় খুব একটা উদ্বেগ ছিল না। এদিকে চামড়া খাতে নেয়া ঋণের দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা কাঁচা চামড়ার মোকাম গড়ে তুলতে সরকারের কাছে সাভার ট্যানারি পল্লীর কাছাকাছি পৃথক জমি চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই জমি দেয়া হয়নি। অন্যদিকে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত শ্রমিকদের মধ্যেও রয়েছে অস্থিরতা। তাদের কেউ কেউ পরিবার নিয়ে এখনো হাজারীবাগেই থাকছেন। আবার কেউবা গেছেন সাভারে। জানা গেছে, সাভারের ট্যানারি পল্লীর কাছাকাছি শ্রমিকদের উপযোগী ঘরবাড়ি তেমন নেই, যা আছে তাও ভাড়া বেশি। এসব কারণে দুর্দশায় আছেন চামড়া শিল্পের শ্রমিকরাও। সবমিলিয়ে চরম উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের কাঁচা চামড়ার সবচে বড় বাজার চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ডিউটি ইস্যু নিয়ে চীনের বাজারে বাংলাদেশি কাঁচা চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। তাই রপ্তানিযোগ্য এই কাঁচা চামড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। গত পাঁচ বছর ধরে অব্যাহতভাবে কাঁচা চামড়ার দাম কমছে। কেননা গত ঈদের পর এখন পর্যন্ত সেভাবে চামড়া রপ্তানি করতে পারেনি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। তবে প্রতিনিয়ত কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। গত ছয় বছর আগে বিক্রি হওয়া ৯০ টাকা বর্গফুট দরের গরুর চামড়া এবার বিক্রি হবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকায়। সরকার এই দরই নির্ধারণ করে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল সর্বনিম্ন ৮৫ আর সর্বোচ্চ ৯০ টাকা। একইভাবে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল সর্বনিম্ন ৫০ আর সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে সেই লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ৫০ আর সর্বনিম্ন ৪৫ টাকা। একইভাবে খাসির চামড়ার দর ঠিক করে দেয়া হয়েছে সর্বনিম্ন ১৩ আর সর্বোচ্চ ১৫ টাকা। দেখা গেছে, গত ছয় বছরে কোরবানির গরু ও খাসির চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে কমেছে ৪০ টাকা।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হাজারীবাগ ও সাভারের মধ্যে চামড়া পরিবহনে এবার ব্যয় বাড়বে। এতে চামড়া তৈরি পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। তারা জানান, কাঁচা চামড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনা-নেয়া করতে গিয়ে অপচয় বেড়ে যায়। এতে চামড়া নষ্টও হয়।
ট্যানারির মালিক আবু তাহের বলেন, আমাদের চায়নার মার্কেট নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে কোনো বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এসব বিষয় চিন্তা করে চামড়া কিনতে হবে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশন সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমছে। তাই বাংলাদেশেও এর দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। সংগঠনটি জানিয়েছে, এমনিতেই এ বছর চাহিদা কম। কারণ গত বছর কেনা চামড়া রয়ে গেছে ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন, বাংলাদেশি চামড়ার বাজারে মন্দা, ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দরপতন কিন্তু টাকার দাম বৃদ্ধি, চামড়ার পুরোনো মজুত রয়ে যাওয়া- এসব কারণে এ বছর চামড়ার দর কমিয়ে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, চামড়ার দাম নির্ধারণ করা না হলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করে ফেলে। এতে যারা গরিব ও প্রকৃত কাঁচা চামড়ার টাকাটা পাবে তারা ন্যায্য দামটা পায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম ৩৩ শতাংশ কমেছে। তাই এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার অবস্থা আসলেই খারাপ। তাই গত বছরের তুলনায় এ বছর দর কমিয়ে চামড়ার দাম ঠিক করে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এটি করা হয়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খুচরা বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মে মাসে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৩৫০ টাকা। এক বছর পর তা বাড়িয়ে অর্থাৎ ২০১৬ সালের মে মাসে তা দাঁড়ায় ৩৮০ টাকা কেজি। এছাড়া ২০১৭ সালে প্রতি কেজি গরুর মাংসের খুচরা দাম নির্ধারণ করা আছে ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা। এবারো তাই রয়েছে। কাজেই গরুর দাম বাড়লেও কমছে চামড়ার দাম।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশন সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন কোরবানির ঈদে প্রায় এক কোটি পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ পিস গরুর চামড়া। বাকিগুলো ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার। এরমধ্যে কোরবানির সাতদিনের মধ্যে তারা প্রায় ৪০ লাখ চামড়া পেয়ে যান। বাকিগুলো পরে সংগ্রহ করা হয়।