২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের ন্যূনতম চাহিদা ৯০ আসন। বিএনপি দিতে চায় ৫০টি।
একদিকে নিজ দল, অন্যদিকে নতুন ও পুরোনো দুই জোট—তিন দিক রক্ষা করে আসন সমঝোতায় পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে বিএনপিকে।
বিএনপি ও জোটের সূত্রগুলো জানায়, আগের ২০-দলীয় জোট ও নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের ন্যূনতম চাহিদা ৯০টির মতো আসন। শরিকদের এই চাহিদা মেটাতে বিএনপি হিমশিম খাচ্ছে। যদিও বিএনপি এখন পর্যন্ত সব আসনে নিজের দলীয় মনোনয়নও চূড়ান্ত করেনি।
দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ১০ বছর পর বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে সরকারের নিপীড়নের শিকার হওয়া মাঠনেতাদের বড় একটি অংশের মধ্যে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে প্রবল প্রত্যাশা জেগেছে। তাদের এই প্রত্যাশাকে চাপা দিয়ে দুই জোটের শরিকদের বড় আকারে ছাড় দেওয়া বেশ কঠিন। আবার দলের নীতিনির্ধারকদের নজর রাখতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোট ও মিত্রদের দিকেও। তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী কারা, কে কোন আসনে—এসব বিবেচনায় রেখেই বিএনপিকে প্রার্থী ঠিক করতে হচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিএনপি ৩০০ আসনে দলীয় মনোনয়ন–প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার শেষ করেছে। এখন বাছাই চলছে। চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রকাশ করতে আগামী রবি বা সোমবার পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এ সময়ের মধ্যে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে পৃথকভাবে আসন সমঝোতার ব্যাপারে আলোচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি এখনো ব্যস্ত নিজেদের দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে। আমরা আশা করছি, আগামী শনি বা রোববারের মধ্যে সবার সঙ্গে আসনের ব্যাপারে আলোচনা হবে।’
দুই জোটের কত আসন
বিএনপি ছাড়া ২০-দলীয় জোটের অন্য শরিক ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে কত আসন দেওয়া হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। জানা গেছে, দুই জোটের শরিকেরা কমপক্ষে ৯০টির মতো আসন দাবি করছে বিএনপির কাছে। এর মধ্যে জামায়াত অন্তত ৩৫টি (যা গত নির্বাচনে তারা পেয়েছিল) চাইছে। এই জোটের অন্য শরিকদের ন্যূনতম দাবি ২০টির মতো। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চার শরিক গণফোরাম, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য কমপক্ষে ৩০-৩৫টি আসন চায়। কিন্তু বিএনপি মাঠের খোঁজখবরের ভিত্তিতে দুই জোটের শরিকদের সর্বোচ্চ ৫০টির মতো আসন ছাড়ার কথা চিন্তা করছে।
এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পিরোজপুর-১ আসনটির ব্যাপারে নাছোড় অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। সেখানে সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী সক্রিয়। কিন্তু বিএনপি এই আসন জাতীয় পার্টির (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দারকে দিতে চায়। জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি অলি আহমদ চট্টগ্রাম-১৪ থেকে নির্বাচন করবেন। এই আসন চান গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ও ঐক্যফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুব্রত চৌধুরী। সমঝোতা হলে বগুড়া-২ আসনটি দিতে হবে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। ২০০৮ সালে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন এ কে এম হাফিজুর রহমান। নাগরিক ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এস এম আকরাম নারায়ণগঞ্জ–৫ আসনে প্রার্থী হতে চান। সেখানে বিএনপির চারবারের সাংসদ আবুল কালাম আজাদও মনোনয়নপ্রত্যাশী।
একইভাবে গণফোরামের মহাসচিব মোস্তফা মহসীন মন্টু চান ঢাকা-২ বা ঢাকা-৩। কিন্তু একটিতে বিএনপির গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও অন্যটিতে আছেন আমান উল্লাহ আমান। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি নির্বাচন করতে চান টাঙ্গাইল-৮ আসনে। সেখানে আছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান। লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী আছেন আশরাফ উদ্দিন নিজান। সমঝোতা হলে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে ছেড়ে দিতে হবে। জেএসডির মহাসচিব আবদুল মালেক রতন চেয়েছেন কুমিল্লা-৪ আসন। সেখানে বিএনপির শক্ত প্রার্থী মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী। ঐক্যফ্রন্টের জোট করার কারণে গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর মনোনয়ন পাচ্ছেন, এমনটা ধরে নিয়ে মৌলভীবাজার–২ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এম এম শাহীন যোগ দিয়েছেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে। আর এই আসনের সাবেক সাংসদ ও জাতীয় পার্টির (জাফর) সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নওয়াব আলী আব্বাস খান এরশাদের জাপা থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। এ ছাড়া মোস্তফা মহসিন মন্টুকে দেওয়া হতে পারে ঢাকা-৭।
তিনটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে মনোনয়ন
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, এবার বিএনপি সব আসনেই মূল প্রার্থীর পাশাপাশি বিকল্প এক বা দুজন রাখার চিন্তা করছে। যাতে বাছাইয়ে মূল প্রার্থী কোনো কারণে বাদ পড়লে বিকল্প প্রার্থী থেকে যান। বিএনপি ও তাদের দুই শরিক জোটের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মোটা দাগে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন। এক. যাঁর জেতার সম্ভাবনা বেশি। দুই. মাঠে টিকে থাকতে পারেন। তিন. আর্থিকসহ প্রাসঙ্গিক সক্ষমতা। এর পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীদের যোগ্যতা, নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এবং এলাকায় গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপি সর্বশেষ ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেবার ২৫৯টি আসনে বিএনপি এককভাবে দলীয় প্রার্থী দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীসহ জোটের অন্য শরিকদের ৪১টি আসন ছেড়েছিল বিএনপি। এবারও ৪৫–৫০টি আসন শরিকদের জন্য ছাড়ার কথা ভাবছে দলটি।
এবার মৃত্যু ও বয়সজনিত কারণে বিএনপির প্রার্থী তালিকায়ও কিছুটা পরিবর্তন আসছে। বার্ধক্যের কারণে স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার ও মাহবুবুর রহমান নির্বাচন করছেন না। পঞ্চগড়-১ আসনে জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে নওশাদ জমির বিএনপির মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। আর দিনাজপুর-২ আসনে মাহবুবুর রহমান স্থানীয় নেতা মঞ্জুরুল ইসলামের নাম সুপারিশ করেছেন বলে জানা গেছে। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নির্বাচন করছি না। বয়স হয়ে গেছে। তরুণদের সুযোগ দেওয়া উচিত।’
স্থায়ী কমিটির সাত নেতার আসনে
চলতি নভেম্বর মাসে মারা গেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। এর আগে গত কয়েক বছরে মারা যান আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, এম শামসুল ইসলাম ও আর এ গণি। আরেক সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে। তরিকুলের যশোর-৩ আসনে তাঁর ছেলে অমিত ইসলাম, খন্দকার দেলোয়ারের মানিকগঞ্জ-১ আসনে তাঁর দুই ছেলের একজন, সাকা চৌধুরীর চট্টগ্রাম-৭ আসনে ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, হান্নান শাহর গাজীপুর-৪ আসনে ছেলে রিয়াজুল হান্নান নির্বাচন করবেন। আর এম শামসুল ইসলামের মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল হাই মনোনয়ন চেয়েছেন। এম কে আনোয়ারের কুমিল্লা-২ আসনে তাঁর পরিবারের কেউ মনোনয়ন চাননি।
গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা নেই
গত কয়েক বছরে মাঠের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মারা গেছেন। তাঁদের আসনে পরিবারের সদস্য বা দলীয় নেতারা মনোনয়ন পাচ্ছেন। নওগাঁ-৩ আসনে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর ছেলে পারভেজ হামিদ সিদ্দিকী মনোনয়ন পেতে পারেন। ফজলুর রহমানের (পটল) নাটোর-১ আসনে তাঁর স্ত্রী কামরুন্নাহার শিরিন, জয়পুরহাট-১ এ মোজাহের আলী প্রধানের ছেলে মাসুদ রানা প্রধান অথবা দলের নেতা ফয়সল আলীম, চাঁদপুর-২ এ নুরুল হুদার স্থলে জালালউদ্দিন অথবা আতাউর রহমান ঢালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২–এ ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জায়গায় উকিল আবদুস সাত্তার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনে কাজী আনোয়ার হোসেনের ছেলে কাজী নাজমুল হোসেন, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে আফরোজা খান মনোনয়ন পেতে পারেন।
বগুড়া-২ আসনে প্রার্থী হতে পারেন ঐক্যফ্রন্টের মাহমুদুর রহমান মান্না। রাজশাহী-৩–এ বিএনপির প্রবীণ নেতা কবির হোসেন মনোনয়ন ফরম নেননি। পঞ্চগড়-১ ও ২ আসনের একটি চায় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের প্রার্থী মজিবর রহমান মারা গেছেন। সেখানে নতুন মুখ আসবেন। কুমিল্লা-৩ আসনের প্রার্থী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ এবার দেশে নেই। কুমিল্লা-৫ আসনটি দেওয়া হচ্ছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে এবার কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দলীয় প্রার্থী হতে পারেন। ময়মনসিংহ-১ আসনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী টি এইচ খানের ছেলে আফজাল এইচ খানের মনোনয়ন এবার নড়বড়ে। সেখানে আজগর আলী মনোনয়ন পেতে পারেন। ময়মনসিংহ-৪ আসনের আগের প্রার্থী এ কে এম মোশাররফ হোসেন অসুস্থ। এখানে ড্যাব নেতা এ জেড এম জাহিদ হোসেন নতুন মুখ হতে পারেন।
কুমিল্লা-৭ আসনে এবার এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ জোটের প্রার্থী হচ্ছেন। ভোলা-১ ও ২ থেকে ২০০৮ সালে জোটের প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) দুই সহোদর আন্দালিভ রহমান ও আশিকুর রহমান। আশিক আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আর আন্দালিভ এবারও ভোলা-১ আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী হিসেবে থাকছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০–দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমরা একটা বিষয়ে সবাই একমত যে এমন প্রার্থী দেওয়া হবে, যাঁর জেতার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে কারও ভাই–বন্ধু বিবেচনা করা হবে না। কারণ, আমরা এবার নির্বাচন করছি সম্পূর্ণ বৈরী পরিস্থিতিতে।’