মহাজোট সরকারের মেয়াদে এর আগে ১১ ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়। কাল পেতে পারে নতুন তিনটি ব্যাংক।
সরকারের ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ বাস্তবায়নে আরও ব্যাংক অনুমোদন দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নির্বাচনের আগেই নতুন তিনটি ব্যাংক দিতে প্রস্তুত হয়েছে ‘স্বাধীন’ এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব ব্যাংক অনুমোদন হওয়ার কথা। এর ফলে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
নতুন তিনটি ব্যাংক অনুমোদন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১ নভেম্বরও অর্থনৈতিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় বলেছিলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই নতুন ব্যাংক দেওয়া হচ্ছে।
২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত মহাজোট সরকারের মেয়াদে ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সবটাই ছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি এ সময়ে ব্যাংক পেয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ পুলিশও। দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি ৫৮টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ১০টির বেশি ব্যাংক রয়েছে নাজুক অবস্থায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ব্যাংক দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তে সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশ করছে। এর ফলে আরও নতজানু হয়ে পড়ছে সংস্থাটি। নিজের পদ রক্ষা করতে গিয়ে গভর্নরসহ অন্যরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রক্ষা করতে পারছেন না। আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এখন বাস্তবায়ন হবে কেন?’
সূত্র জানায়, গত ২৯ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তিনটি ব্যাংকের বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে এসব ব্যাংকের নথিপত্রে ঘাটতি থাকায় তা অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যাংক তিনটি হলো বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক। এর মধ্যে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পেতে আবেদন করেন বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন। আওয়ামী লীগের সাংসদ মোরশেদ আলম বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক। প্রস্তাবিত এই ব্যাংকটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়াল, পোশাক খাতের ব্যবসায়ী সাহাবুদ্দিন, চট্টগ্রামের কেডিএস গ্রুপ ও ম্যাক্স গ্রুপ, পোশাক খাতের লাবিব ও শারমিন গ্রুপসহ আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী। যোগাযোগ করা হলে জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের যে সমস্যা ছিল, তা ইতিমধ্যে সমাধান হয়ে গেছে। আমরা ব্যাংক পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।’
পিপলস ব্যাংক পেতে আবেদন করেছেন প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা এম এ কাশেম। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে তাঁর বাড়ি। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ব্যবসা রয়েছে বলে দাবি করলেও এ-সংক্রান্ত পর্যাপ্ত নথিপত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে পারেননি। গত পর্ষদ সভা শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছিল, এম এ কাশেমের সম্পদের হিসাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সত্যায়িত হয়ে আসতে হবে। আর সিটিজেন ব্যাংক পেতে আবেদন করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মা জাহানারা হক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গত মঙ্গলবার এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংক দিচ্ছে না। যথাযথ নথিপত্র দেখেই ব্যাংক অনুমোদন হবে।’
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। এরশাদ সরকারের মেয়াদে (১৯৮২-৯০) নয়টি ব্যাংক অনুমোদন পায়। ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় নতুন আট ব্যাংক অনুমোদন পায়। ২০০১-০৬ সালে চাপ থাকলেও বিএনপি কোনো ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি। আর ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ ব্যাংক ও ২০০৯ থেকে এখনো পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা; যা বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর সঙ্গে অবলোপন করা ৪০ হাজার কোটি টাকার, ঋণ যুক্ত করলে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবটি পুরোপুরি সঠিক নয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এতটুকুই বলব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নিজস্ব ক্ষমতা, তার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না।’