ইতিহাসে চোখ ফেরানো যাক। যদিও এটা বলে রাখা ভালো, এ ভূমে ক্ষণে ক্ষণে ইতিহাস বদলায়। পাঠ্যবইয়ে কী লিখা থাকবে তা রাজনীতিবিদরা ঠিক করে দেন। বিএনপি’র জন্ম সেনা ছাউনিতে- এ অভিযোগ মিথ্যা নয়। সত্য ইতিহাস এর সাফাই দেবে। জিয়াউর রহমানের হাতে তৈরি এ দল। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তার উত্থান। সেই চট্টগ্রামেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।
সামরিক ছায়ায় তৈরি বিএনপিকে গণতন্ত্রের ছাতার নিচে নিয়ে আসেন বেগম খালেদা জিয়া। যদিও বিএনপি কখনোই পুরো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হতে পারেনি অথবা হয়নি। সে বাহাস আলাদা বিষয়। স্বামীর অকস্মাৎ মৃত্যুতে অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দিনের পর দিন অনমনীয়ভাবে মাঠে থেকে রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নেন। বিএনপিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নাটকীয় জয় পায় বিএনপি। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই বলে থাকেন যে, খালেদা জিয়ার দুই মেয়াদের মধ্যে প্রথম মেয়াদ অনেক ভালো ছিল। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সে সময় বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া হয়। নারীর ক্ষমতায়নে খালেদা জিয়ার ভূমিকা পশ্চিমা বিশ্বেও প্রশংসিত হয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচনের পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি একশ’র বেশি আসনে জয় পায়।
২০০১ সালের ভূমিধস জয়ের পর অবশ্য বিএনপি সরকারের বেশকিছু কার্যক্রম বিতর্কিত হয়। বিশেষ করে জঙ্গি তৎপরতা এবং দুর্নীতি বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহল বিএনপি’র ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তাদের তৎপরতার জেরে ‘ওয়ান ইলেভেন’ আসে। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে সে ব্যাপারে খালেদা জিয়াকে খবর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা আমলে নেননি। রাজনীতি আর খেলায় কী হলে কী হতো তার অবশ্য কোনো গুরুত্ব নেই। ওয়ান ইলেভেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তি জীবন এবং রাজনীতি দুটোকেই তছনছ করে দেয়। এক পর্যায়ে তাকে এবং তার দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভাগ হয়ে যায় বিএনপি। ওয়ান ইলেভেনের সেই ধাক্কা আজও কাটিয়ে ওঠতে পারেনি বিএনপি। এক যুগ ধরে বিএনপি’র রাজনীতি ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর ধরে কারাবন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাসিত। অন্যতম প্রধান নেতা মির্জা ফখরুলের নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় আর প্রশ্ন দুটিই রয়েছে। দুটি নির্বাচন দলটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। নানা চটকদার বক্তব্য দিতে অবশ্য বিএনপি নেতারা পিছিয়ে নেই। কেন বিএনপি’র এই অবস্থা? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখেছেন, এই পরিস্থিতির পেছনে নানা কারণ রয়েছে। গত এক দশকে গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভাবনীয় সব বিক্ষোভ হয়েছে। আরব অভ্যুত্থান তছনছ করে দিয়েছে বহু শাসকের ক্ষমতা, বহু মানুষের জীবন। আবার দেশে দেশে কট্টরপন্থি শাসকদের উত্থান হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বহু সমীকরণও পাল্টে গেছে। পশ্চিমা দুনিয়া বহুক্ষেত্রেই এখন আর আগের মতো ম্যাটার করে না।
বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতিতে নানা দেশি-বিদেশি সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আঞ্চলিক প্রভাবশালী মহল বিএনপি’র প্রতি এখনো নমনীয় হয়নি। নরেন্দ্র মোদি প্রথম মেয়াদে জয়লাভ করার পর নয়াপল্টনে এক ধরনের উল্লাস দেখা গেছে। কিন্তু তা মিইয়ে যেতে সময় লাগেনি। সে যাই হোক, সারা দুনিয়ার রাজনীতিতে এখন বড় সব পরিবর্তন হচ্ছে রাস্তায়। এ ভূমেও নানা ঐতিহাসিক পরিবর্তন এসেছে রাজপথে। বিএনপি তার ইতিহাসে অনেক জাঁদরেল মহাসচিব দেখেছে। যদিও সাংগঠনিকভাবে কখনোই বিএনপি দেশের এক নম্বর দল ছিল না। দলটির রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একটি বড় ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় ধরে বিএনপি এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো গোছানোর কাজ চলছে। যে গোছানোর কাজের সম্ভবত কোনো শেষ নেই। দলটি এখন পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছে প্রেস রিলিজ আর ঘরোয়া রাজনীতির ওপর। প্রতিদিন সকাল-বিকাল ব্রিফিং হয় পল্টনে। এ নিয়ে দেশের কারও কোনো আগ্রহ আছে বলে জানা যায় না। কিছু হলে একটি বিবৃতি দিয়ে কাজ সারেন মহাসচিব। সেটাও অবশ্য প্রায়শই বেশ বিলম্বে। অন্য নেতারা প্রেস ক্লাবে কিছু ঘরোয়া আলোচনা সভায় হাঁকডাক দেন। তমুক দিন থেকে তারা আন্দোলনে নামবেন। সেদিন আর আসে না। ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এক ‘টকশো’তে বলেছেন, জাতীয়তাবাদী দল এখন বিবৃতিবাদী দলে পরিণত হয়েছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই স্বীকার করেন, বিএনপি’র তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। নানারকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাদের। কেন্দ্রীয় এবং অনেক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। তারা কারাভোগও করেছেন। কিন্তু দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে তাদের মামলার গতি-প্রকৃতি আলাদা। তাদের কারাভোগের গতি-প্রকৃতিও এক নয়। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলে থাকেন, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনেকেই ‘ম্যানেজড’। তারা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। বিএনপি’র রাজনীতি এখন তাদের প্রায়োরিটি তালিকায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয়। কেউ কেউ রাজনীতি থেকেও বিদায় নিয়েছেন। যারা নেতৃত্বে রয়েছেন ঘন ঘন জরুরি বৈঠকেই নিজেদের দায়িত্ব সারছেন। তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। মহাসচিবও তৃণমূলমুখী নন। দলের ভবিষ্যৎ কী হবে সে প্রশ্নে স্থায়ী কমিটির হাতে কোনো রূপরেখা নেই।
ঐক্যফ্রন্ট, না ২০দলীয় জোট কোনো প্রশ্নেই সুনির্দিষ্ট কৌশল নেই। যেমন জামায়াত ইস্যু ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। যেটা বিএনপি’র রাজনীতির জন্য মোটেই সহায়ক নয়। জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়লে দলটিকে আরো মূল্য দিতে হবে। হেফাজত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু জামায়াত নয়। এটা দেখার পরও বিএনপি নেতারা চোখ বুজে বসে রয়েছেন। স্কাইপে কথা বলার এক ঘণ্টার মধ্যে মূল আলোচ্য বিষয় যথাস্থানে পৌঁছে যায়। এটা যেন এক ম্যাজিক। সাত সমুদ্রের ওপারে কি কথা হয় তাও ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, একদিন মুসলিম লীগেরও পতন হয়েছিল।
বিএনপিতে যে আত্মসমালোচনা একেবারেই নেই তা নয়। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বুধবারই ঢাকায় এক আলোচনায় বলেছেন, ‘আমরা যে স্লোগান দেই রাজপথ ছাড়ি নাই, তার আগে আমার বলতে ইচ্ছা করে রাজপথে নামি নাই।’ কিন্তু আলাল এই কথাটি বলেছেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভেতরে এক আলোচনা সভায়। এই ঘরোয়া আর প্রেস পলিটিক্স বিএনপিকে ঠিক কোন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তা দেখতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে।