টানা তিন মাস আকাশচুম্বী থাকার পর কিছুটা কমে এসেছিল পিয়াজের দাম। মৌসুম শুরু হওয়ায় দাম ধীরে ধীরে নাগালের মধ্যে আসার কথা। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ফের অস্থির হয়ে উঠেছে পিয়াজের বাজার। গত তিন দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৭০-৮০ টাকা । ফলে খুচরা বাজারে আবারও ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলেছে পিয়াজ। ব্যবসায়ীদের এবারের দাবি বৈরি আবহাওয়া। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর বৈঠকের চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই ফের বাড়লো পণ্যটির দাম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের রপ্তানি বন্ধ। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকাসহ নানা কারণে গত বছরের শেষভাগে পিয়াজের বাজার অস্থির ছিল।
পরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ আর নতুন পিয়াজ বাজারে আসায় কিছুটা নিম্নমুখী ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দাম। কিন্তু কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে তীব্র শীতও রয়েছে। যে কারণে জমি থেকে পিয়াজ উঠাতে পারছেন না কৃষক। ফলে সরবরাহ কমায় আবার বেড়েছে দাম। তাদের অভিযোগ, পিয়াজের উৎপাদন ও আমদানি নিয়ে গত কয়েক দিনে মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বাজরের অস্থিরতার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই বাজারে পিয়াজের দাম বাড়তে থাকে। তিন দিনে পাইকারি বাজারে দেশি পিয়াজের কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৪০-৫০ টাকা আর খুচরায় ৭০-৮০ টাকা। এদিন সকালে খুচরা বাজারে ভালো মানের দেশি পিয়াজ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৯০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১০০-১২০ টাকা। চীন-মিসরের বড় পিয়াজ প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে যা ছিল ৫০-৬০ টাকা।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি পিয়াজ ব্যবসায়ী? মেসার্স আলী ট্রেডার্সের পরিচালক মো. সামসুর রহমান জানান, গত তিন দিন পিয়াজের সরবরাহ কম থাকায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত বাজার চড়া ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর তীব্র শীতের কারণে কৃষক ক্ষেত থেকে পিয়াজ ওঠাতে পারেননি। এ কারণে বাজারে পিয়াজ কম এসেছে। ফলে দাম বেড়েছে। তবে এখন বাজার একটু কমতির দিকে। আবহাওয়া ভালো থাকলে আর কৃষক ক্ষেত থেকে পিয়াজ ওঠাতে পারলে বাজার স্বাভাবিক হবে। তিনি জানান, বর্তমানে পাইকারি বাজারে মুড়িকাটা জাতের দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়। আমদানি করা মিসরের পিয়াজ বিক্রি হয় ৭৫-৮০ টাকা, পাকিস্তানি পিয়াজ ১২৫-১৩০ এবং চীনা ৬০-৬৫ টাকা।
এ ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে আমদানি পিয়াজের পাশাপাশি বড় চাহিদা মেটাচ্ছে দেশি মুড়িকাটা পিয়াজ। আগামী ২০-২৫ দিনে মুড়িকাটা পিয়াজ উঠবে। এরপর দেশি পিয়াজ যেটা সারা বছর বিক্রি করি, ওইটা বাজারে আসবে। মুড়িকাটা ওঠানোর ২০-৩০ দিনের মধ্যে দেশি পিয়াজ উঠানো শুরু হয়। ওই সময় যেন আমদানি পিয়াজের সরবরাহ বাজারে পর্যাপ্ত থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই পিয়াজের বাজার স্বাভাবিক থাকবে বলে জানান এ ব্যবসায়ী।
কাওরান বাজারের পিয়াজ ব্যবসায়ী আশরাফ জানান, বৃষ্টির কারণে কয়েক দিন ধরে দাম বাড়ছে। আড়তে পিয়াজ সরবরাহ কম। আমরা পাবনা থেকে পিয়াজ নিয়ে আসি। সেখানে পিয়াজের কেজি পড়েছে ১৬০-১৭০ টাকা। মুড়িকাটা কিং পিয়াজ যেটা বিদেশি বীজ কিন্তু দেশে উৎপাদন হয় ওই পিয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও এ পিয়াজ পাইকারি ৮০-৯০ টাকা বিক্রি হয়েছে। তিনি জানান, বাজারে পিয়াজের দাম কমের দিকেই ছিল। বৃষ্টির কারণে দাম বাড়ছে। তবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে দাম কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য: বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসন্ন রমজানের আগেই ৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২ লাখ টন পিয়াজ আমদানি করা হবে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও আমদানি করবে। আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির উপস্থিতিতে ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
জানা গেছে, বৈঠকে ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক মুনাফার পরামর্শ দিয়ে আসন্ন রমজান মাসের চাহিদা মেটাতে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, আদা, রসুন, খেজুর ও পিয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় মজুত সৃষ্টির কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এক্ষেত্রে সরকার ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রীর এই আহ্বানের পরের দিন শুধু পিয়াজই নয়, বাজারে দাম বেড়েছে আদা, রসুন, ভোজ্যতেল ও চিনিসহ সব ধরনের শাকসবজির।
ওদিকে পিয়াজ আমদানি সংক্রান্ত তোফায়েল আহমেদের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই বিপরীত কথা বললেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, পিয়াজের জন্য আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। তারা হঠাৎ করে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে আমরা বিপদে পড়ে যাই। এর পর থেকে শুধু ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকলেই হবে না। আমাদের কাছে পিয়াজ উৎপাদনের যে প্রযুক্তি আছে, তাতে আমরা পিয়াজ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত থাকব। সমস্যা হচ্ছে, কৃষক পিয়াজ উৎপাদন করতে চান না। সে কারণে আমরা বাণিজ্যমন্ত্রীকে বলেছি, এ বছর মৌসুমে যেন পিয়াজ আমদানি করা না হয়। কৃষক যেন পিয়াজ উৎপাদন করে লাভ করতে পারেন। এ বছর দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে পিয়াজ উদ্বৃত্ত থাকবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
পিয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সমপ্রতি সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সঙ্কট থেকে শিক্ষা নিয়ে সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে হবে। আগামী বছর থেকে ৩০-৩২ লাখ টন পিয়াজ উৎপাদনের পরিকল্পনা করতে হবে। এজন্য পিয়াজের ক্ষেত্রে শূন্য সুদে ঋণ দেয়া যায় কি না চিন্তা করছি। এখন ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়। যেভাবেই হোক কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সংরক্ষণ সক্ষমতা বাড়াতে হিমাগার তৈরির ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাশাপাশি ভর মৌসুমে পিয়াজ আমদানি বন্ধ রেখে কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বর্তমানে দেশে পিয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। ১৬ থেকে ১৭ লাখ টন দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ৮ থেকে ৯ লাখ টন আমদানি করা হয়। পিয়াজ আমদানির ৯৫ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে।