পাণ্ডুলিপি যেমন পোড়ে না, ব্যালটও পুড়বে নাপাণ্ডুলিপি যেমন ভোট কেন্দ্রে সাধারণত যাই না। আগে যেতাম। গত নির্বাচনের সময় দুটি কেন্দ্র দেখতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেটা অতীত। বারিধারার একটি কেন্দ্রে কর্মরত এক প্রিসাইডিং অফিসার আমাকে দেখেই বললেন, কী ব্যাপার! ভোট দেখতে এসেছেন বুঝি! বলতে পারেন, সেটাই। হেসে দিয়ে বললেন, আসল ভোটতো দেখতে পাবেন না। সেটা আবার কী? অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। রাতেইতো কাজ শেষ হয়ে গেছে। অবাক হইনি।
কারণ ভোরবেলা এক সহকর্মী ফোনে এমনটাই জানিয়েছিলেন। যাই হোক সিটি ভোট নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল। সবাই বলেছেন, এবার বোধ করি আমাদের হুঁশ হবে। রাতে ভোট হবে না, ভোট হবে দিনেদুপুরে মেশিনে। জমজমাট প্রচারণা। বাজারে নানা গুজব। কেউ কেউ বলেছেন, এই ভোটে কেউ হারবে না। যদিও আমি বরাবরই বলেছি, এটা জেতার খেলা, ড্রয়ের খেলা নয়। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কথা শুনে সেদিনই নিশ্চিত হয়েছিলাম, কী ঘটতে যাচ্ছে। তিনি সোজাসাপটা বলেছিলেন, ইভিএম মেশিনেও কারচুপি করা সম্ভব। যদি কেন্দ্র দখল করা যায়। বাস্তবে হলোও তাই। ভোর থেকেই কেন্দ্র দখল হয়ে গেল। ভিন্নমতাবলম্বী কিছু এজেন্ট কেন্দ্রমুখী হয়েছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে নিঃশব্দে বাড়ি ফিরে যান। অনেক এজেন্ট কেন্দ্রেই আসেননি। আসার মতো অবস্থাও ছিল না। কিন্তু ভোটার! জানবাজি রেখে তারা কেন্দ্রে হাজির হলেন। স্থিরবিশ্বাস ভয়ভীতি যতোই থাকুক না কেন, দেখে আসি মেশিন কী করে? তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। মেশিন যে রাতেই কব্জা হয়ে গেছে। প্রশিক্ষণও হয়ে গেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট বুথে গেলেন। সটান দাঁড়িয়ে রইলেন দু’ জন। আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। একজন বললেন, আপনার ভোট হয়ে গেছে। বাড়ি চলে যান। ভোটার যদি বিগড়ে বসেন, তখন অন্যজনের কথা এই মার্কায় ভোট দেন। তাতেও যদি ভোটার বিরত না হন, তখন নিজেই বিশেষ মার্কায় ভোট দিয়ে দিলেন। ভোটার কী করবেন তখন! বড্ড অসহায়। নালিশ জানানোর কোনো জায়গা নেই। নির্বাচনী কর্মকর্তারা নির্বিকার। পুলিশ দেখেও দেখছে না। আরেক কেন্দ্রে দেখা গেল প্রিসাইডিং অফিসার মোবাইল ফোনে গান শুনছেন। ভোটারদের চিৎকার শুনেও তিনি না শোনার ভান করছেন। এই ভোটে আমরা কী পেলাম? ফিঙ্গার প্রিন্ট আপনার, ভোট আমার। এটাই বোধ করি বড় প্রাপ্তি। একসময় ছিল, নিজের ভোট নিজে দেবো। যাকে খুশি তাকে দেবো। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভোটের সংজ্ঞাও বদলে গেছে। শনিবারের ভোটে ভোট দেখতে গিয়ে এক মহিলার আকুতি দেখে অবাক হয়েছি। এই সময়েও মানুষ ভোট দেয়ার জন্য এভাবে লড়াই করে। দক্ষিণের একটি কেন্দ্র। সকাল ১১টা। বাইরে বড় ধরনের জটলা। শ’ খানেক লোক। বুকে ব্যাজ নিয়ে। এদের অনেকেই ভোটার নন। ডিএমপি কমিশনারের ভাষায়, বহিরাগত। পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকতেই চিৎকার। দুই জন মহিলা রেগেমেগে অস্থির। তারা বলছেন, মহিলাবুথে পুরুষ ঢুকবে কেন? তারা কেন একটি মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য জবরদস্তি করবে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রের কথা শুনে কিছুটা অবাক হই। কারণ, তাকে বিশেষ মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়। যদিও তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। ক্যানসেল বোতামে টিপ দিয়ে চলে এসেছেন। এরকম ক’জন চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি? আর করলেইবা কি? ভোটতো হয়ে গেছে। এই ভোটে নানা অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছি আমরা। নিজে দেখেছি, অন্যের কাছে শুনেছি। বৃটিশ হাইকমিশনারতো ভোট বন্ধ রেখে বিরিয়ানি খাওয়ার উৎসবও দেখলেন খালি চোখে। ভোরের সংবাদপত্রগুলোতে ইভিএম ও ভোট কারচুপির বহু ঘটনা স্থান পেয়েছে। কলকাতার আনন্দবাজারে ইভিএমে কারচুপির একটি শিরোনাম দেখেছিলাম কয়েকমাস আগে। বাংলাদেশেও কারচুপি দেখলাম, ছিনতাই দেখলাম। নির্বাচন কমিশন অবশ্য দেখেনি। তারা ভোটের হিসাব মেলাতেই ব্যস্ত। শেষরাতেও তারা ভোট গণনা করতে পারেনি। তারা মেশিনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি। রাজধানী ঢাকার ভোটে যদি এমন হয় তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে! ভোটের প্রতি মানুষের অনাস্থা, এবার স্পষ্ট। সাড়ে বারো লাখ নয়া ভোটার কেন্দুমুখী হবেন তাইতো আশা করা গিয়েছিল। অজ্ঞাত নয়, জানা কারণেই তারা ভোটদান থেকে বিরত। সিটি ভোট থেকে আমরা কী পেলাম? সাবেক সচিব ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ আবু আলম মো. শহীদ খান বলেছেন, এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। তার মতে, গণতন্ত্রের পরাজয় হয়েছে। অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে দেখা গেল, ভোটার কমতে কমতে ৫ বা ১০ ভাগে নেমে গেছে। তখন কি হবে? কিছু সিভিল আমলা, সামরিক আমলা, পুলিশ আর অল্প ভোটার মিলে সরকার হচ্ছে। এটা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। জোসেফ স্ট্যালিনের একটি বিখ্যাত উক্তি এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন, নির্বাচন চলছে। মানুষ জানছে। এটাই যথেষ্ট। যেসব মানুষ ভোট দেয় তারা কোনো কিছু নির্ধারণ করে না, বরং যেসব মানুষ ভোট গণনা করে তারাই সব নির্ধারণ করে। কথায় আছে, আপনি সত্যের কাছে গিয়েও সত্যের দেখা পাবেন না। যেমন পাণ্ডুলিপি কখনও পোড়ে না, ব্যালটও পুড়বে না। আবার হয়তো ফিরে আসবে।
মতি চৌধুরী, ঢাকাপোড়ে না, ব্যালটও পুড়বে না