অর্থের জোগান কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্য নিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্য কমিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থ সরবরাহ আরো কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রেপো (পুনঃ ক্রয় চুক্তি) সুদহার আরো এক দফা বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, হেড অব বিএফআইইউ ও নির্বাহী পরিচালকরা।
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ববাজার এখনো অস্থির, এর মধ্যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হানা দিয়েছে বন্যা। এমন পরিস্থিতিতে সতর্কতার পথেই হাঁটতে চাইছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘এবার সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী। টাকার অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক মান, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা হবে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। ’
নীতি সুদহার বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে ব্যাংকগুলোকে এখন বেশি সুদ দিতে হবে। এতে সস্তা টাকার দিন শেষ হয়ে আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজে আসবে। আর আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে নতুন পুনরর্থায়ন স্কিম চালুর ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর। পাশাপাশি বিলাসজাতীয় দ্রব্য যেমন বিদেশি ফল, অশস্য খাদ্যপণ্য, টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে ডলারের ওপর চাপ কমবে, যার বদৌলতে সুরক্ষিত রাখবে রিজার্ভ ও মুদ্রার বিনিময় হার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে এই নতুন সুদহার কার্যকর হবে।
বাড়ানো হলো নীতি সুদহার : চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি চাপ প্রশমনের পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এক দিন মেয়াদি রেপোর সুদ হার ৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে গত ২৯ মে এই হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বাড়ানো হল রেপো হার। তবে রিভার্স রেপো হার আগের মতোই ৪ শতাংশ, বিশেষ রেপো হার ৮ শতাংশ এবং ব্যাংক রেট ৪ শতাংশ রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট।
বেসরকারি ঋণের লক্ষ্য কমিয়ে ১৪.১ শতাংশ : নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ। চলতি বছর যা ছিল ১৪.৮০ শতাংশ। অর্থাৎ আগের মুদ্রানীতির চেয়ে দশমিক ৭০ শতাংশ কমিয়ে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির। একই সময়ে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ব্যাপক মুদ্রার সরবরাহ ধরা হয়েছে ১২.১ শতাংশ, যা কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সিলিংয়ের সমষ্টির তুলনায় কিছুটা কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুন পর্যন্ত ঋণ বেড়েছে ১৩.১ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার আলোকে ঋণ গ্রহণের প্রবৃদ্ধি ৩৬.৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.২০ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এরই মধ্যে গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৭.৪২ শতাংশ, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।