৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী শহর পুরান ঢাকা অপরিকল্পিত নগরায়ণে এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। সরু রাস্তা, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ, ঘনবসতিসহ বিভিন্ন কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে পুরান ঢাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১১টি ওয়ার্ডজুড়ে বিস্তৃত পুরান ঢাকা। অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না।
ড্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় পাঁচ ফুট প্রশস্তের নিচে ১০.৭৯ কিলোমিটার, পাঁচ থেকে ১০ ফুটের ৪৭.৫০ কিলোমিটার, ১০ থেকে ১৫ ফুটের ৩২.৬৪ কিলোমিটার, ১৫ থেকে ২০ ফুটের ১৬.৪৮ কিলোমিটার, ২০ থেকে ৩০ ফুটের ১২.৩৬ কিলোমিটার, ৩০ থেকে ৫০ ফুটের ৩.৬০ কিলোমিটার, ৫০ থেকে ১০০ ফুট প্রশস্তের ৪.৩১ কিলোমিটার এবং ১০০ ফুট প্রশস্তের ওপরে মাত্র ০.০৪ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে, যা আদর্শ মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম।
ড্যাপ পরিসংখ্যান বলছে, পুরান ঢাকার ১১টি ওয়ার্ডে বর্তমানে ২৪ হাজার ৫০৪টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একতলা ৯ হাজার ২৮২টি, দোতলা তিন হাজার ৭৩৯টি, তিনতলা দুই হাজার ৭২৪টি, চারতলা দুই হাজার ৭০৫টি, পাঁচতলা দুই হাজার ৬১১টি, ছয়তলা দুই হাজার ৪৯৭টি, সাততলা ৭২০টি, আটতলা ১২৫টি, ৯ তলা ৪৭টি, ১০ তলা ২৫টি, ১১ তলা ১৭টি এবং ১২ তলার বেশি উচ্চতার ভবন ১২টি।
রাজউকের বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি প্লটে বাড়ি নির্মাণের জন্য যে ন্যূনতম জায়গা ফাঁকা (সেটব্যাক) হিসেবে ছেড়ে দেওয়ার কথা, চকবাজারসহ বহু এলাকায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে পুরান ঢাকায়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার সমস্যা নিয়ে শতবার বলা হচ্ছে। এখনই যদি সমস্যাগুলো বিবেচনায় না নেওয়া হয়, চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ কিছু ঘটলেও কিছু করার থাকবে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাস্তবসম্মত চিন্তা করতে হবে। সংকীর্ণ রাস্তা, রাসায়নিকের গুদাম সরানোসহ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা না গেলে পুরান ঢাকা দিনে দিনে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ’
পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজার, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন ভবনের নিচে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ট্রান্সফরমার। অনেক ভবনের নিচেই রাসায়নিকের কারখানা। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলিতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১২৪ জন মারা যায়। সেখানে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ১১৭ জন। এ দুর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের শুরু হয়। পরে নিচের দোকানগুলোতে আগুন ধরে। এরপর গুদামের রাসায়নিকে আগুনের তীব্রতা বাড়ে। ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আশপাশের রাস্তাগুলো তিন-চার ফুট প্রশস্ত। দুই পাশে লাগোয়া ভবন। দুটি ভবনের মধ্যে নেই ফাঁকা জায়গা।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে পুরান ঢাকায় ছোট ছোট ত্রুটিপূর্ণভাবে স্থাপনা নির্মাণ করায় পর্যাপ্ত রাস্তা, পার্ক ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া নিচু জায়গায় ভবন নির্মাণ করায় এবং রাস্তাগুলো পর্যাপ্ত প্রশস্ত না হওয়ায় সেসব রাস্তা ও জায়গা অনুন্নত থেকে যাচ্ছে। এর বাইরে পুরান ঢাকার মূল সমস্যার মধ্যে অকার্যকর রোড নেটওয়ার্ক, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান, জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব, নিম্নমানের জীবনযাত্রা অন্যতম।