কেমন আছেন সমলা, সুফিয়া, জহুরা বেগমরা?

পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী। পরনে পুরনো, ছেঁড়া শাড়ি। গত রোববার বেলা তখন ৩টা। মাথা নিচু করে ঝিমুচ্ছিলেন। সামনে রাখা কিছু অর্ধপচা আলু, বেগুন, শসা। ডাকতেই চমকে উঠলেন। বললেন, কিছু নিবেন?

পাশেই বসে ছিলেন আরও দুজন বয়সী নারী। দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তাদের সামনেও কিছু সবজি। বুঝাই যাচ্ছে সেগুলো কুড়িয়ে আনা।

সবজির পচা, নষ্ট হওয়া অংশ কেটে ফেলে বাকিটা বিক্রি করেন তারা। তাদের একজন সুফিয়া। ঠিক কতো বছর আগে ঢাকায় এসেছেন- দিনক্ষণ তার মনে নেই। ঝিমুতে ঝিমুতেই বললেন, বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও। স্বামী খোঁজখবর রাখে না। বিয়ে করেছে গ্রামে আরও কয়েকটা। সুফিয়া বেগম নিজের বয়স বলতে না পারলেও অনুমান করা যায়। পঞ্চাশ পেরিয়েছে। বললেন, এক ছেলে আছে সেও খবর রাখে না। এক মেয়ে, বিয়ে দিয়েছেন। সুফিয়া ঢাকায় একাই থাকেন। তবে তার কোনো নির্দিষ্ট থাকার জায়গা নেই। কাওরান বাজারে কুড়িয়ে পাওয়া সবজি বিক্রি করেন দিনভর। রাতে থাকেন যেখানে ঠাঁই মেলে সেখানেই। কখনো বা কোনো দোকানের সামনে ফাঁকা জায়গায়। কখনো ব্যস্ত সড়কের ফুটপাতে। বললেন, বস্তি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য নেই। পাশের হোটেল থেকে সুফিয়াদের মতো আরও যারা এমন সবজি বিক্রি করেন তাদের জন্য খাবার আসে। দিনচুক্তি। দুপুর আর রাত। দুইবেলার জন্য দিতে হয় ৬০ টাকা।
সকালে নাস্তা? সকালে খাইলে চলুম কি করে? তাই খালি পেটেই থাকতে হয়। সুফিয়া বেগমের পাশেই বসে ছিলেন জহুরা বেগম ও সমলা। জানালেন, সকাল থেকে রাত দশটা/এগারোটা পর্যন্ত সবজি বিক্রি করেন তারা। থাকেন কাওরান বাজার রেললাইনের পাশেই কাঠের দোকানের সামনে। প্রতিদিন জায়গার ভাড়া বাবদ দিতে হয় পঞ্চাশ টাকা করে। দিনে আয় হয় দুই থেকে তিনশ’। মাস শেষে ৬/৭ হাজার টাকা যা আয় হয় সেখান থেকে গ্রামে পাঠাতে হয়। এই বয়সেও চালাতে হয় সংসার। সমলা, জহুরা বেগম দুজনেই এসেছেন কিশোরগঞ্জ থেকে। যদিও তারা গ্রামে বিধবা ভাতা পান, কিন্তু তা দিয়ে চলে না। সমলা গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরও পেয়েছেন। ছেলে-মেয়ে থাকে সেখানে। কিন্তু তাদের খরচ পাঠাতে হয় নিয়মিত সমলাকেই। জহুরা বেগম আক্ষেপ করে বলছিলেন, একসময় এই সবজি বেচে চলতে পারতাম। এখন পারি না। সবকিছুর খরচ বেড়ে গেছে। না পারি নিজে ভালোভাবে চলতে না পারি গ্রামে পাঠাতে। অসুখ বিসুখে ডাক্তার দেখানো হয় না অনেকদিন। জহুরা বেগমের প্রশ্ন, সবকিছুর এত দাম। কীভাবে বাঁচি কন?

জহুরা বেগম ভুলে গেছেন শেষ কবে মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছেন। বললেন, মাছই জোটে না। আগে পাঙ্গাস খাইতাম। সেইটারও দাম বাড়লো। তেলাপিয়ারও দাম বাড়লো।

জীবনের এই বয়সে এসে পরিবার নিয়ে থাকার কথা, অবসর কাটানোর কথা, সমলা-সুফিয়া-জহুরা বেগমদের। কিন্তু না! এখনও নিজের পেটের খাবার জোগাড়েই দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। তাতেও যেন ভালো থাকার নিশ্চয়তা মেলে না। কথা বলতে বলতে সমলা বেগম একটা প্যারাসিটামল খেলেন। দুদিন ধরে তার জ্বর। জ্বর নিয়েই তাকে সবজি কুড়াতে হয়েছে। সাধারণত আড়তদার, ব্যবসায়ীদের ফেলে দেয়া সবজিই তারা কুড়িয়ে আনেন। সুযোগ মিললে কিনে আনেন। ধুয়ে-মুছে বিক্রি করেন। ফুটপাথের ভাসমান হোটেলে সেগুলো বিক্রি হয়। বস্তিবাসীরাও তাদের নিয়মিত ক্রেতা। ফেরার সময় সমলা বেগম বলে উঠলেন, কতোজন কতো ছবি তুলে নিয়ে গেল আমাগো। কপাল আর খুললো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *