দেশে প্রচলিত শ্রম-আইনের বাস্তবায়ন হলে রানা প্লাজা ধ্বসে শ্রমিক হতাহত হতো না

NDP-Alamgir_Mojumder_picআলমগীর মজুমদার :

আজ মহান মে দিবস। শ্রমিকের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস। এখন থেকে ১২৮ বছর পূর্বে শ্রমিকরা তার ৮ ঘণ্টার কর্মদিবস এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জঙ্গি আন্দোলন করে। ধর্মঘটের মাধ্যমে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়। এই সার্থক ধর্মঘট ও আন্দোলনের সূত্র ধরে শ্রমিক শ্রেণী লড়াই করে বাঁচার ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হতে শিখে।
মহান মে দিবসের শিক্ষায় ব্রতী হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষ আত্মপ্রত্যয়ী এবং নিজেদের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় উজ্জ্বীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় শ্রমিক শ্রেণী পৃথিবীর কয়েক দেশে নিজস্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণী আইএলওর ২৬তম অধিবেশন তথা ১৯৪৪ সালে অর্থাৎ, এখন থেকে ৭০ বছর পূর্বে গৃহীত প্রস্তাব বা ফিলাডেলফিয়া ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত ‘(অ) শ্রমিক শ্রেণী কোনো পণ্য নয়, (আ) প্রগতি/উন্নয়নের প্রয়োজনে সংগঠন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, (ই) উন্নয়নের/অগ্রগতির পথে দারিদ্র্য প্রতিবন্ধক, (ঈ) অগ্রগতির সোপানকে সার্বজনীন করার প্রয়োজনে ত্রি-পক্ষীয়তার নীতির ভিত্তিতে শ্রমিক-মালিক-সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে মুক্ত আলোচনা ও গণতান্ত্রিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ সকল বিষয়ের সমাধান খোঁজা’ এর ন্যায় ন্যূনতম অধিকার অর্জনেরও সৌভাগ্য হয়নি। এই না হওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা প্রকৃত অর্থে মহান মে দিবসের দীক্ষার আলোকে নিজেদের লক্ষ্য হাসিলে তথা দাবি আদায়ে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে পারিনি। পারিনি আত্মপ্রত্যয়ী হতে। পারিনি লক্ষ্য অর্জনে ত্যাগ স্বীকার করতে। পারিনি আত্মত্যাগে বলীয়ান হতে।  এই না পারার কারণ হচ্ছে, শ্রমিক হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব শ্রেণী সত্ত্বায় বিকশিত না হতে পারা।  এতদসত্ত্বেও নিজস্ব সত্ত্বায় বলীয়ান হওয়ার আপসহীন সৎ-প্রচেষ্টা যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ শ্রমিক নিজস্ব শ্রেণীসত্তায় উজ্জীবিত থেকে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে সক্ষম হয়েছে। যখন থেকে শ্রমিকের নেতৃত্বে সুবিধাবাদী বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়ার আবির্ভাব ঘটল তখন থেকেই শ্রমিকের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেপথে পরিচালিত হতে শুরু করল। এর অন্যতম কারণ, বর্ণিত নেতৃত্ব শ্রমিক শ্রেণীর সত্ত্বার সাথে একাকার হতে পারেনি। ফলে, আন্দোলন-সংগ্রামে সুবিধাবাদ এমন মাত্রায় পেয়ে বসে যে, শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য হাসিল এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের চেয়ে বেতন বাড়ানোর আন্দোলনই মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে করে মালিকগোষ্ঠী ও তাদের প্রতিভূ সরকার সুযোগ গ্রহণ করে। প্রথমেই কায়দা করে সাদা-কাপড়ে শ্রমিকদের ‘কর্মচারী’ আখ্যা দিয়ে কল-কারখানা শ্রমিকের সাথে ব্যবধান সৃষ্টিতে মদদ জোগায়। আর এভাবেই ক্রমান্বয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে বহুধা বিভক্তিতে ঠেলে দেয়া হয়।। খুব সুকৌশলে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’কে ‘জাতীয় বেতন কাঠামো’ ও জাতীয় মজুরি কমিশনে বিভক্তি টেনে এর কার্যকারিতা কেবল সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রেখে বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন শ্রমিককে বিভিন্ন সেক্টরে শ্রেণীবিন্যাস করে ভিন্ন ভিন্ন ‘ন্যূনতম মজুরি বোর্ড’-এর আওতায় বিভক্ত করে দেয়া হয়। এই ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ ১০% মালিকও মানেন না।

পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে যেখানে নাগরিক অধিকারের বিষয়াবলী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়, সে সকল দেশে কর্মচারী ও শ্রমিককে আলাদা না করে, সরকারি বা আধা-সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ না করে সর্বস্তরের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য একটি ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারিত থাকে। তারা এ ধরনের ব্যবস্থা এজন্যই রাখেন যাতে খেটে খাওয়া মানুষ প্রাপ্য ন্যূনতম মজুরির ভিত্তিতে অন্তত একজন সভ্য মানুষ হিসেবে তার ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে সক্ষম হন। অর্থাৎ, জীবনযাত্রার সর্বনিন্মতম মান বজায় রাখার জন্যই ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরী’। আমাদের শ্রমিকরা এখনও পর্যন্ত জাতীয় ন্যূনতম মজুরিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত প্রায় সর্বক্ষেত্রে। বঞ্চিত সামাজিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা থেকেও। আমাদের সমাজের দ-মু-ের হোতাদের বিবেচনায় শ্রমিক হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। ওরা কাজ করবে, শ্রম দেবে, টাকা নেবে ব্যাস শেষ। ওদের বেশি কথা বলার সুযোগ দেয়া যাবে না। ওদের প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠবে। এমন মানসিকতার কারণেই স্পেকট্রাম, তাজরীন ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনা। রানা প্লাজার বিভীষিকা শুধু বাংলাদেশকে কাঁদায়নি, বিশ্বকেও কাঁদিয়েছে। ২০১৩-এর ২৪ এপ্রিল থেকে অদ্যাবধি কেবল শোক-মাতম, বক্তৃতা-বিবৃতি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তদন্ত-অধিকতর তদন্ত, শ্রমিকদের জন্য সাহায্যের আবেদন-নিবেদন ইত্যাদি অনেক কিছুই হয়েছে। কোনো কিছুরই কমতি নেই। এ সুযোগে অনেকেই মানবতার অবতার হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন। অনেকে সুপরামর্শকের তালিকায় নিজেকে ও প্রতিষ্ঠানের নাম এন্ট্রি করিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের বেশিরভাগ ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ‘উদোর পিন্ডি ভূঁদোর ঘাড়ে’ চাপাতে চেয়েছেন এবং এখনও তাই করে চলেছেন। কিন্তু, প্রকৃত অর্থে কারা এই রানা প্লাজা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তাদের দিকে কেউ অঙ্গুলি তুলেছেন না। এত বড় ট্র্যাজেডির পরও কেন আসল সত্য আড়ালের চেষ্টা হবে। এ কি রাজনৈতিক অপচেষ্টা, না অন্য কিছু। শ্রমিকের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও কেন সেদিন শ্রমিককে ওই ভবনে কাজ করতে বাধ্য করা হলো? কারা বাধ্য করল? রানা প্লাজার মালিক তো অবশ্যই তার পাশাপাশি আর কারা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী? এ ভবন তৈরিতে সার্টিফিকেটে দিয়েছিল কে বা কারা? ভবন ধসের দুদিন পূর্বেই তো ওই ভবনের ফাটল ধরা নিয়ে হৈচৈ হচ্ছিল। এমনকি মিডিয়াতে খবর প্রচার হওয়ার পরও ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৬১ ধারার’ প্রয়োগ এখনও বিদ্যমান সেই ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত কোর কমিটি’ ঘুমিয়েছিল কেন? এই কোর কমিটির সদস্য-সচিব শ্রম পরিচালক সাহেব, এই কমিটির অন্যতম  চিফ ইন্সপেক্টর অব ফ্যাক্টরিজ অ্যান্ড স্টাবিলিশমেন্ট (বর্তমানে ইন্সপেক্টর জেনারেল)-কে নিয়ে আহ্বায়ক সাহেব ও অন্যান্যদের সাথে পরামর্শ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না কেন? এখনকার মোবাইল ও ইন্টারনেট সমৃদ্ধ উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থার সময়েও ৪৮ ঘণ্টায়ও রানা প্লাজা বন্ধে যথাসময়ে কোনো পদক্ষেপ সূচিত হলো না কেন? পরবর্তীতে নিজেদের দোষ এড়াবার জন্যে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর পদ্ধতির মাধ্যমে নিন্মস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসনের তৎপরতা প্রদর্শনীই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট? বিষয়টি কি এমন যে, ‘কর্তার পাদে (বায়ু নিঃসরণে) গন্ধ নেই!’

বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে বর্তমান প্রচলিত শ্রম ও শিল্প আইনের যথোপযুক্ত সমাধান পাওয়া যাবে। এ জন্য নতুন ‘কমিশন’ গঠনের প্রয়োজন নেই। সমস্যা নিরসনে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ার পরও ৩৭০ দিনেও রানা প্লাজায় ধ্বংসস্তূপের ক্ষত শুকানো গেল না কেন? ঘোষিত বিভিন্ন তহবিলের মাধ্যমে এ পর্যন্ত যে টাকা পাওয়া গেছে তা যথাযথভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা হলেই তো বোদ্ধাজনের মতে সমস্যার সমাধান দেয়া যেত চমৎকারভাবে। চাকরি খুইয়ে যারা অসহায় হয়ে পড়েছে তাদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। এদের সংস্থান বিজেএমইএ’র ৫ হাজার ৪০০ সদস্যের কারখানাতে কি হতে পারে না? গত ২৬ এপিলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন ‘বিজিএমইএ’র সভাপতি মোঃ আতিকুল ইসলাম সাহেবের সাক্ষাৎকার পড়ে যা মনে হলো তা হচ্ছে, উনারা সর্বাত্মক প্রয়াস নিয়েছেন রানা প্লাজায় সৃষ্ট ক্ষত সারাতে। উনি বোধহয় ভুলে বসে আছেন যে, দুর্ঘটনায় (তাও মালিকের দোষে) ক্ষতিপূরণ প্রদানের দায়িত্ব মালিকপক্ষের। সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের এলিট শ্রেণীর দায়িত্ব হচ্ছে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করা। সহযোগীরা তো আপনাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। আপনারা তারপরও তাকিয়ে আছেন বিদেশী ক্রেতাদের ও প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের দিকে! পোশাক শিল্পের সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে সরকারের নিকট থেকে তো আপনারা কর সুবিধা পেয়েছেন ২ হাজার কোটি টাকা (প্রথম আলোর ২৪ এপ্রিলের সম্পাদকীয় মতে)। এরপরও এ ক্ষত সারাতে আপনাদের এত ইতস্ততা থাকা কি ন্যায়সঙ্গত? আপনারা যত দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন ততই আপনাদেরই মঙ্গল। বিদেশী ক্রেতারাও আমাদের প্রতি ততই আস্থাশীল হবে। শিল্প বেঁচে থাকবে।

শ্রমিক রুটি-রুজির সংস্থান পাবে। দেশ আপনাদের সহযোগিতায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে অর্থনীতির মজবুত ভিত গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
প্রসঙ্গত, বলতে চাই, উৎপাদন ও উন্নয়নের  প্রধান নিয়ামক শক্তি হচ্ছে শ্রমিক। মহান সে দিবস শ্রমিক-মালিক সংহতি রচনার শিক্ষা দেয়। মহান মে দিবস মালিক কর্তৃক শ্রমিককে আস্থায় নেয়ার শিক্ষাও দেয়। এই মহান মে দিবসের শ্রমিক ধর্মঘটে ভীত হয়ে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের চুরুট কারখানার মালিক শ্রমিকের ৮ ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি মেনে নিয়েছিলেন। এই মালিকই ২ মাস পরে এই বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন যে, আমার শ্রমিকরা আমাকে গত ২ মাসে যে উৎপাদন ও লাভ দিয়েছেন তা গত ২ বছরেও  আমি পাইনি। তাই, মালিকপক্ষকে নিবেদন করতে চাই এই বলে যে, শ্রমিককে আস্থায় নিন, শ্রমিককে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিন, শ্রমিককে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিন। যথাসময়ে শ্রমিকের সাথে আলোচনার টেবিলে বসুন, শ্রমিক কি বলতে চায় শুনুন। শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত মজুরি দিন। বিদেশের মালিকরা পারলে আপনারা পারবেন না কেন? এ সব ক্ষেত্রে সরকারিভাবে শ্রম ও শিল্প আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের উচিত মালিক পক্ষকে চোখ বুজে সমর্থন না জুগিয়ে যথাসময়ে আইনের যথোপযুক্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া। তাহলেই শ্রম ও শিল্প ক্ষেত্রে বিরাজিত সমস্যার দ্রুত নিরসন সম্ভব। এতে অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। দেশে সমৃদ্ধি আসবে। শ্রমিকও বাঁচবে।

লেখক : সভাপতি ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *