জিরো টলারেন্সে সরকার

1399481240. নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারের ঘটনায় সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। ক্ষমতার মাত্র সাড়ে ৩ মাসের মাথায় সরকারের এ ধকল কাটিয়ে উঠতে নিজের রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। জড়িত যেই হোক, তদন্তে যার নামই বেরিয়ে আসবে তাকে আইনের আওতায় আনতে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় র‌্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক (কমান্ডিং অফিসার) লে. কর্নেল তারেক সাইদ মাহমুদসহ তিন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তারেক সাইদ বর্তমান মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর জামাতা। অন্য দু’জন হলেন মেজর আরিফ হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক প্রধান লে. কমান্ডার এমএম রানা। গতকাল সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে তারেক এবং আরিফের অকালীন অবসরের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এমএম রানাকে নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। এর আগে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে র‌্যাবের সিও (তারেক সাইদ) সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর নিকটাত্মীয় এমন বিষয়টি উত্থাপিত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আমি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পন্ন করে দেশ ভালোভাবে পরিচালনা করছি। এরই মধ্যে যদি কেউ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, আমি এগুলো বরদাশত করব না। মন্ত্রীর নিকটাত্মীয় হলেও অপরাধী, অপরাধীই। প্রয়োজনে মন্ত্রীকেই দল থেকে বের করে দেব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে রাজনীতি করি। মানুষ হত্যার রাজনীতি করি না।
সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান দেশের বাইরে থাকায়, তার দায়িত্বে থাকা সেনা অফিসারকে নিজের দফতরে ডেকে আনেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের ঘটনার ব্যাপারে সার্বিক খোঁজখবর নেন। প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত রিপোর্ট চান। তদন্ত রিপোর্ট ২-১ দিনের মধ্যে জমা দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা অফিসার। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের অভিযোগ তদন্ত করছে। এ ছাড়া সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার করা তদন্ত রিপোর্ট গত মঙ্গলবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মানবকণ্ঠকে বলেন, তদন্তে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, ৭ জনকে অপহরণ-খুনের ঘটনায় অভিযোগের তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যে কোনো সময় অভিযুক্তদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, উপযুক্ত অভিযোগের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মূল আসামিদের ধরতে সারাদেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকা এবং বিমানবন্দরেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তদন্তে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত অপহরণ ও খুনের নেপথ্যে ৬ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগটিকে সামনে রেখেই তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রধান সন্দেহভাজন ও টাকা গ্রহীতা হিসেবে তিন র‌্যাব কর্মকর্তা, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলে ও নূর হোসেনকে টার্গেট করেই এগোচ্ছে টাকা লেনদেনের তদন্ত কার্যক্রম। তবে পর্যায়ক্রমিকভাবে র‌্যাব কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা হিসাব নম্বর তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ছয় থেকে সাতজনের হিসাব থেকে ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। শনিরআখড়া যমুনা ব্যাংকের শাখা ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শিমরাইল শাখার দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গেছে। সূত্র জানায়, খুনের ৬ কোটি টাকার জোগানদাতা নূর হোসেন চেয়ারম্যান ছাড়াও ঠিকাদার আবু সুফিয়ান, নূর হোসেনের ভাইপো ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল, বিএনপি নেতা ও ২নং ওয়ার্ডে নজরুলের সঙ্গে নির্বাচনে পরাজিত ইকবাল হোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি ইয়াসিন, থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু এবং বিএনপি নেতা হাসমত আলী হাসুর নাম রয়েছে। জানা যায়, তারা সবাই নজরুল ইসলামসহ ৭ জনকে খুন করতে বিভিন্ন অঙ্কের টাকার জোগান দেন। গোয়েন্দারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো খতিয়ে দেখছেন।
এদিকে মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধেও সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। নজরুলের শ্বশুরের দাবি অনুযায়ী, ওই ছেলের মধ্যস্থতায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আলোচিত এ হত্যাকা-ের নেপথ্য হোতা নূর হোসেনের সঙ্গে ওই মন্ত্রীপুত্রের ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। সে সূত্রেই মন্ত্রীর জামাতা র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাইদ মাহমুদের সঙ্গে নূর হোসেনের যোগাযোগ হয়।
জানা যায়, নূর হোসেন চেয়ারম্যানের সঙ্গে সড়ক ও জনপথের কাজ একসঙ্গে করতেন মন্ত্রীপুত্র। এ ছাড়া তার একটি ফিলিং স্টেশন দেখাশোনা করতেন নূর হোসেন। সম্প্রতি তারা ঢাকা-চিটাগাং চার লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের একটি অংশের উপকরণ সরবরাহের কাজ যৌথভাবে করছিলেন। মন্ত্রীপুত্রের মাধ্যমেই র‌্যাব ১১-এর অধিনায়কের (সিইও) সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে নূর হোসেনের। এর পরই তিনি র‌্যাবের অধিনায়ককে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন। নূর হোসেনের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেন হাসমত আলী হাসু। হাসমত অ্যান্ড ব্রাদার্স, জসিম অ্যান্ড ব্রাদার্স, আমান, শাহজালাল, সুফিয়ান মিলে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দেন। জানা যায়, নূর হোসেন এর আগে পাঁচবার নজরুলকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। পাঁচ পাঁচবার পেরে না ওঠায় এবার র‌্যাব বাহিনী দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছেন।
‘এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না’ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর সন্দেহভাজন সবার দিকেই গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেছেন তারা। তাই লে. কর্নেল তারেক সাইদ, বিএ নং-৪১২৭ মন্ত্রীর মেয়ের জামাই হওয়া সত্ত্বেও তাকে অকালীন অবসর দেয়া হয়েছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হবে। সামনে কয়েক দিনের মধ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে নেয়া কঠোর সিদ্ধান্তগুলো দৃশ্যমান হবে এবং রহস্য পুরোপুরি উšে§াচিত হবে। ইতিমধ্যেই নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ।
গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের শিবু মার্কেটের সামনে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। সে সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, সকাল থেকে ওই এলাকায় র‌্যাবের গাড়ি অবস্থান নিয়েছিল।
একই সময় নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের একজন সহকারী পুলিশ সুপার জানান, তিনি ওই এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে র‌্যাব ১১-এর অধিনায়ককে বহন করা একটি গাড়ি অপহৃত নজরুল ইসলাম ও চন্দন সরকারের দুটি গাড়িকে ফলো করতে দেখেছেন। অপহরণের দিন রাতেই রাজেন্দ্রপুরে একটি সড়কের পাশে নজরুলের গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরদিন রাতে গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে অপহৃত চন্দন সরকারের গাড়ি উদ্ধার হয়। ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যার তীরে এই সাতজনের অর্ধ গলিত লাশ উদ্ধারের পর এ ঘটনার পেছনে র‌্যাবকে অভিযুক্ত করা হয়।
প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র‌্যাব ১১-এর অধিনায়কসহ তিন কর্মকর্তা ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে এই ৭ জনকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। এই অভিযোগের আগে ৩০ এপ্রিল র‌্যাব ১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাইদ মাহমুদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম, র‌্যাব-১১ দুই কামান্ডার মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার মাসুদ রানাকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনার পর হাইকোর্টের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি, র‌্যাবের গঠিত একটি তদন্ত কমিটিসহ চারটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার গোলাম মুহিদ বলেন, নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সম্ভাব্য সব স্থানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছেন। আসামিদের গ্রেফতারে তাদের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই।মানবকন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *