রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারি আইনের তোয়াক্কা না করে ফ্রিস্টাইলে পরিচালিত হচ্ছে- এমনটি জানা যায় স্বাস্থ্য মহাপরিদফতর সূত্রে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীর উল্লেখযোগ্য বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিক ও ম্যানেজাররা অতি মুনাফার জন্য পাড়া-মহল্লা ও সরকারি হাসপাতালের আশপাশে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য ক্লিনিক, হাসপাতাল। এগুলোয় রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হয়। অনাদায়ে রোগীদের আটকে রাখা হয়। কিন্তু হাসপাতাল চালাতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক কখনোই এ বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় পাওয়া যায় না। বাকি সময় তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী দিয়েই কাজ চালানো হয়। অনেক হাসপাতালের মালিক ও ম্যানেজার নিজেই চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে অ্যাপ্রোন পরে চিকিৎসক সেজে রোগীদের চিকিৎসা করেন। বেশির ভাগ হাসপাতালে টেকনিশিয়ানদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। রয়েছে পর্যাপ্ত নার্স ও ওয়ার্ডবয়ের সংকট। রোগীর চিকিৎসায় অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির বদলে হার্ডওয়ার যন্ত্রপাতি যেমন ড্রিল মেশিন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়! প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অনুসরণ করে হাসপাতাল নির্মাণ না করে ভাড়া বাড়িতে গাদাগাদি করে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তা ছাড়া যেসব চিকিৎসক কাজ করেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রীতি র্যাবের অভিযানে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় অনেক ভুয়া চিকিৎসকেরও সন্ধান মেলে। স্বাস্থ্যসেবা মহাপরিদফতরের তথ্যে জানা যায়, রাজধানীর প্রায় ৬০টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অন্তত ৮০ শতাংশই সরকারের জারি করা আইন কোনো না কোনো দিক থেকে না মেনেই পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পর্যবেক্ষণ কমিটির দেওয়া তথ্যে জানা যায়, অধিকাংশ বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক নেই। এসব হাসপাতালে সহকারী ছাড়াই চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনার প্রবণতা আছে। অভাব ডিপ্লোমাধারী প্রশিক্ষিত নার্সেরও। হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো এত স্বল্প যে তাতে রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসা দেওয়ার স্থানসংকুলান করা যায় না। নিয়ম মতে, অনুমোদর ধরে রাখতে হলে একটি বেসরকারি ক্লিনিকের অবশ্যই প্রতি রোগীর জন্য পৃথকভাবে ন্যূনতম ৮০ বর্গফুট জায়গা এবং প্রতি ১০ জন রোগীর জন্য অন্তত তিনজন ডিগ্রিধারী চিকিৎসক থাকতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয়সংখ্যক পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও ন্যূনতম ডিপ্লোমাধারী নার্সও থাকতে হবে।
এদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় মূল্য তালিকা প্রকাশ্যে ঝোলানো বাধ্যতামূলক হলেও কোনো তালিকা দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে রোগীকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছামতো বিল পরিশোধ করতে বাধ্য করে। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম আনোয়ার পাশা জানান, কিছু হাসপাতালে হাড়ভাঙা রোগীর অপারেশনে বিল হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এমনকি গরিব রোগীদের থেকে বিল আদায়ের জন্য অনেককেই এক মাস, কয়েক সপ্তাহ আটকিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় চুক্তির চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ দাবি করা হয়। নিয়ম মতে, প্রতি বেডের জন্য ন্যূনতম ৮০ বর্গফুট স্থানের প্রয়োজন হলেও হাসপাতালগুলোয় গাদাগাদি করে অনেক বেড রাখা হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সরকারি শর্ত ভঙ্গকারী হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তবে এদের শাস্তিবিধানের বিষয়টি পরিচালনা করবেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজুদ্দিন জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র : ১২ এপ্রিল রাজধানীর বাবর রোডে ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে র্যাব-২-এর অভিযান চলে। এতে অদক্ষ ব্যক্তির দ্বারা ও প্রতারণামূলক চিকিৎসার জন্য সাতজনকে জরিমানাসহ জেল দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, গভীর রাতে এ হাসপাতালের মালিক পাইক বাবু ও তার ভায়রা রতন কৃষ্ণ ডাক্তার ছাড়াই নিজেরা রোগীদের অ্যানেসথেসিয়া ও অপারেশন করেন। এতে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসে। রতন জানান, তিনি হার্ডওয়ারের দোকান থেকে কেনা ড্রিল মেশিন দিয়ে রোগীর পায়ের হাড় ফুটো করে টানা দেওয়ার কাজ করেন। অথচ হাড় ফুটো করার উপযুক্ত যন্ত্রের ঘূর্ণনের হার ড্রিল মেশিন থেকে অনেক কম। এ ধরনের স্পর্শকাতর চিকিৎসা দক্ষ ডাক্তার ছাড়া করা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস। আর মালিক পাইক বাবু এসএসসি পাস। জানা যায়, বিভিন্ন ক্লিনিকে ম্যানেজার ও পার্টনার থাকার পর পাইক বাবু নিজেই ১০ বেডের হাসপাতালের মালিক হন। তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের জন্য লাইন্সেস নেন।