পুরো তিন বছর হয়েছে গত ১২ মে। এখনও প্রকাশিত হয়নি ফতোয়া নিয়ে দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়। ২০১১ সালের ১২ মে সর্বোচ্চ আদালত ফতোয়া নিয়ে এই রায় দিয়েছিলেন। রায়ে বলা হয়েছিল, ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া যেতে পারে। তবে এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না।
মহিলা পরিষদের কাছ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ২৪টি। অন্যদিকে, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। এর মধ্যে মামলা হয়েছে পাঁচটি।
২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৮টি। এর মধ্যে ১৬টি মামলা হয়েছে। হত্যার সংখ্যা এক ও আত্মহত্যা পাঁচ। ২০১১ সালে ৫৯টির মধ্যে মামলা হয়েছে ২০টি। একজনকে হত্যা ও ১৩টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। তার মানে হচ্ছে, রায়ের পরও ফতোয়া থেমে থাকেনি, ফতোয়ার নামে নারীর ওপর নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ১২৮টির মতো।
প্রায় এক যুগেরও আগে হাইকোর্ট ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ওই বছরই ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয় এবং শুনানি শুরু হয় ২০১১ সালের ১ মার্চ। ওই বছরের ১২ মে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রায় ঘোষণা করেন। আপিল আংশিক মঞ্জুর করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া যেতে পারে। তবে এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না।
ধর্মীয় বিষয়ে শুধু যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা ফতোয়া দিতে পারবেন। এটা ব্যক্তির স্বেচ্ছায় গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে এমন কোনো ধরনের ফতোয়া দেওয়া যাবে না।
রায়ে আরও বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা দু’টি আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আংশিক মঞ্জুর করা হলো। ঘোষিত রায়ে আরও বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা দু’টি আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আংশিক মঞ্জুর করা হলো। ধর্মীয় বিষয়ে শুধু যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা ফতোয়া দিতে পারবেন। এটা ব্যক্তির স্বেচ্ছায় গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে এমন কোনো ধরনের ফতোয়া দেওয়া যাবে না। তবে রায়ে বলা হয়, যে ফতোয়ার ঘটনাটি অবৈধ বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন, সেটি সঠিক ছিল।
নওগাঁর সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামের এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাবাজার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আদালতের নজরে এলে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয় রুল জারি করেন।
রুলের শুনানি শেষে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি হাইকোর্ট ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনবহির্ভূত বলে রায় দেন। রায়ে বলা হয়,একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে তবে ওই বছরই রায়ের বিরুদ্ধে মুফতি মো. তৈয়ব ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আপিল করেন।
দীর্ঘদিন পর ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আপিল শুনানির তালিকায় আসে। সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষিত হয় ১৯ মে। আদালত অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞ আলেমদের মতামত শোনেন।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি কবে নাগাদ বের হবে জানতে চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমিতো অবসর নিয়েছি, ওটা এখন কী অবস্থায় আছে আমি বলতে পারবো না।’
আপনি তো রায় দিয়েছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় কবে বেরুবে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘আমিতো লিখিনি, অন্য বিচারপতিরা হয়তো লিখছেন। আমি আসলে ওটা নিয়ে কোনও কথাই জানি না।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ফতোয়ার পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাজমেন্ট যদি ঠিকমতো না পাওয়া যায় তাহলে মামলার ফল সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই জাজমেন্টগুলো একেকটা আইন। এসব জাজমেন্টে গাইডলাইন থাকে, নির্দেশনা থাকে। সেগুলো নিয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির একটা বিষয় থাকে। এসব জাজমেন্ট সংশ্লিষ্ট স্থানে পৌঁছাবার পর তারাও সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেয়ে থাকে এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে অবহিত হয়। তিনি বলেন, ‘একটা কথাই প্রচলিত আছে,জাসটিস ডিলেইড, জাসটিস ডিনাইড। আশা করছি, পাবলিক ইন্টারেস্টের মামলাগুলোর জাজমেন্ট খুব তাড়াতাড়িই প্রকাশ হবে।’
অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে দেরি হলে খানিকটা হতাশ হতে হয়। রায় প্রকাশের পরও প্রতিবছর ফতোয়ার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু রায় তাড়াতাড়ি প্রকাশিত হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যতো দ্রুত একেকটি ঘটনায় রুল হয়, ঠিক তত বা যত দ্রুত সম্ভব যদি একটা রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়া যায় তাহলে সেটা পুরো সমাজকেই উপকৃত করে। সোজা কথায় বলতে গেলে– গণমানুষের উপকারেই জাজমেন্ট তাড়াতাড়ি হওয়া উচিত।’ বা ট্রি