বৃষ্টির অভাবে দেশজুড়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপদাহ। ভ্যাপসা গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় দিন দিন বাড়ছে লোডশেডিং। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের লোডশেডিংয়ের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই। সম্ভাব্য উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা সব সময় অপূর্ণই থেকে যায়। দিনের শুরুতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দৈনন্দিন হিসাবে দেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে কিংবা কখনও শূন্যের কোঠায় থাকছে। দিনের শেষে সেই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের উৎপাদনের হিসাবেও রয়েছে গরমিল। গত মার্চ মাসে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুসারে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ৭০০০ মেগাওয়াট। আর সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ৭৫০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দিয়ে ৬০০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুসারে বুধবার সাবস্টেশনে লোডশেডিংয়ের সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে শূন্য মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয় ৭০১৩ মেগাওয়াট। আর সর্বোচ্চ চাহিদা হিসাব করা হয় ৭০০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ১৩ মেগাওয়াট বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতেই বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট। কোম্পানি দু’টির দাবি চাহিদা অনুযায়ী তারা বিদ্যুৎ না পাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। এ জন্য তারা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করেন। বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তব অবস্থার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিদ্যুতের উৎপাদন নিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যে গরমিল প্রসঙ্গে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ বলেন, সরকার ভুল বিবৃতি দিচ্ছে। ১১ হাজার মেগাওয়াটের যে হিসাব দেয়া হচ্ছে তা ডাঁহা মিথ্যা। বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে পুরনো যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে মেইন প্লেটে যে উৎপাদন ক্ষমতা লেখা আছে সে অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না। অথচ বিদ্যুৎ বিভাগ মেইন প্লেটের ডাটা যোগ করে বলছে তাদের সক্ষমতা দশ হাজার মেগাওয়াট। পুরনো এসব যন্ত্রের মাধ্যমে এত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। সরকার নতুন যে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলছে সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১০০০ মেগাওয়াট। আর আগের যে ৬০০০ মেগাওয়াটের জায়গায় উৎপাদন হচ্ছে ৫০০০ মেগাওয়াট। যে কারণে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন হচ্ছে না। ঘাটতি সামাল দিতে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোকে লোডশেডিংয়ের আশ্রয় নিতে হয়।
উৎপাদনে ঘাটতির কারণে ঢাকার বাইরে লোডশেডিংয়ের অবস্থা আরও খারাপ। শীতকালের পর থেকেই ঢাকার বাইরে লোডশেডিং চলছে। বাইরে কলকারখানাগুলোতে বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অথচ এসব জায়গার লোডশেডিংয়ের চিত্র সঠিকভাবে উঠে আসছে না। বিতরণ সংস্থাগুলো তাদের চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ না পাওয়া প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিতরণ বোর্ডের সদস্য স্বপন কুমার সাহা বলেন, কোম্পানিগুলো তাদের চাহিদামতো কেন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না এটা জেনারেশন বিভাগ জানে। আর দৈনন্দিন লোডশেডিংয়ের বিষয়টি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) থেকে হিসাব করা হয়। তারা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারবে। লোডশেডিংয়ের হিসাবে গরমিল প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল হাসান চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দিনের শুরুতে যে হিসাব দেয় সেগুলো ওই দিনের সম্ভাব্য। দিনের শেষে হিসাব না-ও মিলতে পারে। তবে হিসাবের গরমিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর চাহিদা একেক সময়ে একেক রকম হওয়ায় লোডশেডিংয়ের সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে পিডিবি’র হিসাব অনুসারে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে? বর্তমানে ৭৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সরবরাহ প্রতিদিনই নিশ্চিত করা সম্ভব? কিন্তু গতকাল সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয় ৭০০০ মেগাওয়াট। এটা এই সময়ের প্রকৃৃত চাহিদার তুলনায় প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট কম? চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতির কারণে শুধুমাত্র লোডশেডিং হচ্ছে না। অনেক সময় বিতরণ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলেই লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণে বিতরণ লাইনে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া, অতিরিক্ত গরমের কারণে বিতরণের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ায় লোডশেডিং বাড়ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মানবজমিন