মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে আইডি কার্ড মিলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশি-বিদেশি নামি-দামি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। ১০০ টাকায় বানানো যাবে সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ডাক্তারসহ প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার সিল। এমনকি পাসপোর্টে ভুয়া ভিসাও লাগানো যাবে। নিউ মার্কেট থানা সংলগ্ন নীলক্ষেত মার্কেটে অনেকটা প্রকাশ্যেই এ কার্যক্রম চললেও রহস্যজনক কারণে প্রশাসন নীরব। বরং এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে উল্টো পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের অবৈধ উপাজর্নের বড় উৎস এটা। তাই সেখানে কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা পছন্দ নয় তাদের।
সরেজমিন নীলক্ষেত মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, নিউ মার্কেট থানা সংলগ্ন ৩টি মার্কেটের দোকানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পরিচয়পত্র এবং নামি-দামি ব্যক্তিদের সিল তৈরি করা হয়। শতাধিক স্থায়ী এবং ভাসমান দোকান থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ এ ধরনের ভুয়া পরিচয়পত্র এবং সিল সংগ্রহ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্বনামধন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচয়পত্র তৈরি করে দেয়া হয় ১০০ থেকে ২৫০ টাকায়। ব্যক্তিভেদে এর চেয়ে বেশিও রাখা হয়। তৈরিকৃত নকল পরিচয়পত্র রীতিমতো দোকানগুলোতে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যাংক সত্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ে। এগুলো সত্যায়িত করার ক্ষমতা রাখেন সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ডাক্তারসহ প্রথম শ্রেণির সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তারা। কিন্তু নীলক্ষেতে গেলে এসব ব্যক্তির স্বাক্ষর বা সিল নেয়ার আর প্রয়োজন হয় না কারো। মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে সিল কিনে নিজের কাগজপত্রগুলো সত্যায়িত করে নেয়া যায়।
সরেজমিন মার্কেট ঘুরে আরো দেখা গেছে, পাশেই রয়েছে নিউ মার্কেট থানা এবং নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বের হলেই শুরু নীলক্ষেত মার্কেট। মার্কেটের শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত কয়েকটি সারিতে শতাধিক সিল এবং পরিচয়পত্র তৈরির দোকান। দোকানগুলোর সামনেই ছোট টেবিলে বিভিন্ন ধরনের সিল তৈরি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কয়েকটি দোকানে গিয়ে চাইতেই বেশ কিছু সিল বের করে দেন বিক্রয়কর্মীরা। এর মধ্যে বরিশাল হাসপাতালের দু’জন ডাক্তার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব, ঢাকা কলেজের একজন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং কয়েকটি সরকারি কলেজের শিক্ষকের সিল ছিল।
দোকানিরা জানান, সাধারণত ১০০ থেকে ১২০ টাকার বিনিময়ে এসব তৈরি সিল বিক্রি করেন তারা। তবে কেউ অর্ডার দিয়ে দ্রুত কিংবা বিশেষ কোনো ব্যক্তির সিল তৈরি করতে চাইলে তার কাছ থেকে নেয়া হয় ২০০ বা তারও বেশি টাকা। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা যে কোনো ধরনের সিল তৈরি করে দিতে পারেন।
মার্কেটের কয়েকটি সারির প্রায় শতাধিক দোকান ঘুরে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। এসব দোকানে সিল এবং পরিচয়পত্র তৈরি করা হয় কথাটি বড় করে লেখা রয়েছে।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে দেখা গেছে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র জরুরিভাবে সত্যায়িত করার সিল তৈরির অর্ডার দেয়। তবে পরিচয়পত্র তৈরি করা হয় অনেকটা গোপনে। কাগজের লেমিনেটিং এবং প্লাস্টিক পরিচয়পত্র এসব দোকানে তৈরি করা হয়।
কয়েকটি দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কেউ আইডি কার্ড তেরি করতে চাইলে তা করে দেয়া হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ফরম্যাট কম্পিউটারে তৈরি করা আছে। সেখানে তথ্য হালানাগাদ করে ছবি এবং স্বাক্ষর লাগিয়ে পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়।
এজন্য কোনো অনুমতি আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, কোনো অনুমতি নেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের পরিচয়পত্র তৈরির নিজস্ব মেশিন থাকলেও তারা এসব দোকান থেকে পরিচয়পত্র তৈরি করে নিয়ে যায়। এছাড়া তারা নিজেরাও ফরম্যাট অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পরিচয়পত্র তৈরি করে দেন। যে কেউ এলেই ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় এসব পরিচত্র তৈরি করা হয়। এছাড়া ভোটার আইডি কার্ড এবং বিভিন্ন ব্যাংকের সলভেন্সিসহ নানা রকম জাল-জালিয়াতির নকল কাজ এই মার্কেটে করা হয়।
মার্কেটের অপর একজন দোকানদার মো. মিজান জানান, পরিচয়পত্রের ফরম্যাট তাদের করা থাকে। কেউ এটি তৈরি করতে চাইলে তার তথ্য নিয়ে আইডি কার্ড করে দেয়া হয়। এছাড়া সিলও কিছু তৈরি করা থাকে। কেউ ইচ্ছা করলে এগুলো সংগ্রহ করতে পারে। আবার অর্ডার দিলেও এসব তৈরি করে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর আবাসিক-অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্রের রং কেমন, তাও জানিয়ে দিলেন তিনি। মার্কেটের আরো ৩টি দোকান এবং ভেতরের একটি দোকান থেকেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেল।
এ ব্যাপারে নিউ মার্কেট থানার ওসি ইয়াসিন আরাফাত যায়যায়দিনকে জানান, এ সম্পর্কে তাদের কিছু জানা নেই। তাই কোনো অভিযানও চালানো হয়নি।
তিনি আরো জানান, এভাবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়, তাহলে তা অবশ্যই বে আইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে কোনো পরিচয়পত্র নকল করার কোনো ধরনের প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। যাযাদি