সারা দেশে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না করায় গ্রামাঞ্চলে কম বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। ফলে সেখানে লোডশেডিং বেড়েছে। আর ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে সরবরাহে ঘাটতিজনিত লোডশেডিং ছাড়াও বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎবিভ্রাট নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এই অবস্থায় দুই দিন পরেই শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বকাপের আমেজ যখন তুঙ্গে উঠবে, তখনই শুরু হবে পবিত্র রমজান। ফলে এই সময় বিদ্যুতের চাহিদা এখনকার তুলনায় আরও বাড়বে। গত পাঁচ বছরে অনেক ভালো অবস্থানে উঠে আসা বিদ্যুৎ খাতকে তখন আরেকটি কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে।
বিশ্বকাপ ফুটবল ও রমজানের সময় পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন—জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করণীয় চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আশা করি সমস্যা হবে না।’ প্রতিমন্ত্রী এ সময় বিদ্যুৎ ভবনে তাঁর দপ্তরে এই খাতের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করছিলেন।
প্রতিমন্ত্রীর আশাবাদ বাস্তবে কতটা ফল দেয়, তা দেখতে আগামী কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কিছুদিন ধরে লোডশেডিং ও বিদ্যুৎবিভ্রাটে মানুষ বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
গ্রামে বিদ্যুৎ কমই থাকে: একসময় গ্রামের মানুষ বলতেন—গ্রামাঞ্চলে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আসে, কখন বা কতবার তা যায়, সে হিসাব রাখা কঠিন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটলেও মাঝে মাঝেই অবস্থার বেশ অবনতি ঘটে। গত কয়েক দিনে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী ও খুলনার গ্রামাঞ্চলগুলোতে খবর নিয়ে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির বেশ অবনতির তথ্যই পাওয়া গেছে৷
এসব এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলেছেন, দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১২ ঘণ্টা গ্রামের অধিকাংশ স্থানে বিদ্যুৎ থাকে না। একটানা বেশি সময় বিদ্যুৎ থাকে মধ্যরাতের পর, যখন গ্রামের মানুষের বিদ্যুতের তেমন দরকার হয় না।
অধিকাংশ গ্রাম ও ছোট শহর-বন্দরে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। দেশের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৯০ লাখই আরইবির। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আরইবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু লোডশেড হচ্ছে, এটা সত্য। কারণ, চাহিদার শতভাগ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।’
আরইবির চেয়ারম্যান বলেন, বিতরণব্যবস্থার উন্নয়নের কাজ করতে গিয়েও মাঝে মাঝেই কিছু লাইন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সে জন্যও সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। তবে এসবই করা হচ্ছে আসন্ন রমজান মাসকে লক্ষ্য রেখে, যাতে ওই সময় সরবরাহে সমস্যা না হয়।
আরইবির সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে তাঁদের সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। কিন্তু সরবরাহ তিন হাজার মেগাওয়াটের কম। কখনো বৃষ্টি হলে চাহিদা কিছুটা কমে।
শহরে বিদ্যুৎবিভ্রাট: ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা সরকারের কৌশল। কিন্তু বিতরণব্যবস্থার ত্রুটির কাছে হার মেনেছে সরকারি এই কৌশল৷ বিতরণব্যবস্থার ত্রুটির কারণে সৃষ্ট বিদ্যুৎবিভ্রাট সরকার আর গ্রাহক—দুই পক্ষকেই ভোগাচ্ছে৷ কেবলের ত্রুটি, উপকেন্দ্রের সমস্যা, ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ, বিতরণ লাইন অতিভারাক্রান্ত (ওভারলোডেড) হওয়া প্রভৃতি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সরবরাহ করার মতো বিদ্যুৎ থাকলেও গ্রাহক তা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অর্থাভাবে তাঁদের বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে পারছে না বলে দাবি করছে৷
এর সঙ্গে কয়েক দিন ধরে যুক্ত হয়েছে সরবরাহ ঘাটতি। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হওয়ায় এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সরবরাহ ঘাটতির কারণে গতকাল দিনের বেলায় ঢাকায় (ডিপিডিসি ও ডেসকোর এলাকায়) প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে।
ঢাকায় প্রধান বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (পরিচালন ও প্রকৌশল) মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্বকাপ ফুটবল ও রমজান মাসে যাতে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা যায়, সে জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে।
কী করা হবে: সরকারি সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির প্রধান কারণ উৎপাদন কম করা। প্রয়োজনীয় জ্বালানির সংস্থান হলে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় প্রায় সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াট। এ জন্য গ্যাস লাগে ১৪০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ কোটি ঘনফুট।
ভাড়া ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিকসহ তেলচালিত কেন্দ্রগুলোর সর্বমোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট। ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য এই কেন্দ্রগুলোও সব সময় পূর্ণ ক্ষমতায় চালানো হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছর জুন-জুলাই মাসে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট হলেও বর্তমানে উৎপাদন করা হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট।
সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বকাপ ফুটবল ও রমজান মাস সামনে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিদিন দিনের বেলায় সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হবে ছয় হাজার ১০০ মেগাওয়াট। সন্ধ্যায় ইফতারের সময় করা হবে সাত হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট। আর শেষ রাতে সেহ্রির সময় করা হবে সর্বোচ্চ সাত হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। এ জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস ও তেল সরবরাহ বাড়ানো হবে। এই সময় ভারত থেকে আমদানি কিছুটা বাড়ানো সম্ভব কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।