শেখ হাসিনার সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতি যে আচরণ করছে, তাকে কোনোভাবেই ন্যায় বলা যাবে না। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে আইনের দৃষ্টিতে বৈধ দাবি করা হলেও বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিংবা রাস্তায় বোমা-ককটেল হামলার মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের থানা-আদালত-জেলখানায় টানাহেঁচড়া করার বৈধতা দাবি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় সমস্যা হলো সরকার ও প্রধান বিরোধী দল পরস্পরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। এই অস্বীকারের সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক রাজনীতির যেমন বারোটা বাজিয়েছে, তেমনি পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিষয়টি এক পক্ষের হলে তাকে নিবৃত্ত করা সহজ হতো। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে বিরোধী দলের প্রতি যেসব দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তার চেয়ে কোনো অংশে কম করেনি৷
আওয়ামী লীগ নেতাদের যখনই সভা-সমাবেশ করা বিএনপির গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তখনই তারা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার অপচেষ্টার উদাহরণ টানেন। একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায়কে জায়েজ করা যায় না। কিন্তু এ কথাও সত্য যে অতীতের অন্যায়ের প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত ইতিহাসের মীমাংসা এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থিরতা আশা করা যায় না।সম্প্রতি বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কয়েকটি উক্তি প্রধান দুই দলের মধ্যকার রাজনৈতিক বিদ্বেষ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। লন্ডনপ্রবাসী বিএনপির দ্বিতীয় প্রজন্মের এই রাজনীতিক প্রথম বোমা ফাটালেন এই বলে যে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।
কীভাবে প্রথম রাষ্ট্রপতি? জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বেলাল মোহাম্মদ প্রমুখের প্ররোচনায় স্বাধীনতার পক্ষে একটি ঘোষণা দিয়েছেন এটি সত্য। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম উদ্যোক্তা বেলাল মোহাম্মদ ও তঁার সহযোগীরা এর আগেই আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানকে দিয়ে ঘোষণা প্রচার করিয়েছেন। পরে তাঁরা ভাবলেন, একজন সামরিক বাহিনীর সদস্যের কণ্ঠে ঘোষণাটি দেওয়া গেলে দেশবাসী আরও বেশি উৎসাহিত হবেন।
সেই দৃষ্টিতে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটির গুরুত্ব আছে। তিনি প্রথম ঘোষণায় নিজেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দাবি করলেও পরবর্তী ঘোষণায় সেটি সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই ঘোষণা দেন।
পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান সাড়ে পাঁচ বছর এবং খালেদা জিয়া ১০ বছর দেশ শাসন করেছেন। এই সাড়ে ১৫ বছরে তাঁদের কেউই জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করেননি। এমনকি জিয়া নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক বলেও প্রচার করেননি।
কিন্তু হঠাৎ করেই স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর তাঁদের লন্ডনপ্রবাসী পুত্র তারেক রহমান জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন। আর ঢাকায় বসে বিএনপির একশ্রেণির কর্তাভজা নেতা আহ! বেশ বেশ বলে জিগির তুললেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বাকপটু নেতারা বিএনপির এই ঢিলটি মাটিতে পড়ার আগেই পাটকেল ছুড়ে বসলেন। কয়েক দিন ধরে ঢাকায় আর কোনো আওয়াজ ছিল না, নয়াপল্টন ও ধানমন্ডিতে দুই পক্ষ প্রত্যহ সাংবাদিকদের ডেকে নিজেদের পক্ষে শাণিত যুক্তি খাড়া
করতে গলদঘর্ম হলেন। যেন দেশে আর কোনো সমস্যা নেই।
এরপর মে মাসের শেষে জিয়াতনয় আরও একটি গুরুতর বোমা ফাটালেন। এবার তিনি জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেই ক্ষান্ত হলেন না; বললেন, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন, সেটি ছিল অবৈধ। তাঁর যুক্তি হলো ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারই বহাল থাকবে।
১৯৭০ সালে জনগণ যাঁদের নির্বাচিত করেছিলেন, তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানকেই সংসদীয় দলের নেতা