বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মাতোয়ারা বাংলাদেশ

worlcup_bangladesh৭ই জুন বিশ্বকাপ নিয়ে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল ভক্তদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু সেটা ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর রাস্তা বা বুয়েন্স আয়ার্সের কোন বারে নয়। সেটা ঘটেছিল বরিশালে। এটা আমাজন পরিবেষ্টিত কোন শহর নয়। বাংলাদেশের কীর্তনখোলা নদীর অববাহিকায় প্রায় ৩ লাখ বাসিন্দার বন্দরনগরী এটি। আর ঘটনায় সম্পৃক্ত ফুটবল ভক্তরা ছিলেন বাংলাদেশী। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবল উন্মাদনা এভাবেই ফুটে উঠেছে টাইম ম্যাগাজিনে। ‘অনুমানও করতে পারবেন না আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ফুটবল দলের সব থেকে কট্টর ভক্তদের কোথায় পাওয়া যাবে’- এ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছেন এ ম্যাগাজিন। এটি লিখেছেন জোসেফ আলচিন। এতে বলা হয়েছে, বরিশাল পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের খাবার ঘরে মাহমুদ হাসান নামের এক ব্রাজিল ভক্ত ৮৬’তে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যারাডোনার অখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটিকে অবৈধ বলে আখ্যা দিলে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কাছেই বসে থাকা আর্জেন্টিনার ভক্তরা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হন ১১ জন। এরপর ১৮ই জুন বাংলাদেশের উত্তরে হাতিবান্ধা শহরে মিলন হোসেইন নামের এক রেস্টুরেন্ট কর্মী নিহত হন। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ভক্তদের দুই গ্রুপ একে অপরের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারতে থাকলে প্রাণ হারান তিনি। বিশ্বকাপ উন্মাদনায় মাতোয়ারা এক দেশ বাংলাদেশ। আর এখানে দক্ষিণ আমেরিকার দুই ফুটবল পরাশক্তি গোঁড়াধর্মী সমর্থন আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা উড়তে দেখা যায় সর্বত্র। এমন দৃশ্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিমের শহর যশোরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জাতীয়তাবাদী উৎকণ্ঠায় বিদেশী পতাকা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি। মুস্তাফিজুর রহমান নামের এক সরকারি কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, মানুষ প্রিয় দলের জার্সি পরবে বা বিলবোর্ড, ব্যানার ব্যবহার করবে- তাতে কোন সমস্যা নেই। তবে যখন আপনার বাসার ছাদে বিদেশী রাষ্ট্রের পতাকা ওড়ে সেটা ভাল দেখায় না। আমরা আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি, মন্তব্য করলেন তিনি। বিপদ শুধু সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাজধানী ঢাকায় কমপক্ষে ৩ ভক্ত আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমে তাদেরকে বিশ্বকাপ শহীদ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক ইফতি ইসলাম বলেন, ব্রাজিলের প্রতি সমর্থন বাংলাদেশী দরিদ্রতার মধ্যে প্রোথিত। ব্রাজিলের দল দেখতে আমাদের মতো। পেলে, রোমারিও বা নেইমারকে দেখুন- তাদের গায়ের রঙ আমাদের মতোই শ্যামলা, ব্রাজিল গরিব আর আমরাও। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার প্রতি সমর্থনের পেছনে রয়েছে উপনিবেশবিরোধী মনোভাব, কেননা তারা ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল। এ ব্যাখ্যা দিলেন ব্র্যাকের গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ আবু আহসান। তিনি বলেন, ইংল্যান্ড ছিল বাংলাদেশের সাবেক উপনিবেশিক প্রভু। বেকহ্যাম এখানে জনপ্রিয় নয়। অন্যদিকে ম্যারাডোনা পাগলাটে স্বভাবের আর বাংলাদেশীরা পাগলাটে মানুষদের ভালবাসে। ম্যারাডোনা দিনের আলোতে যেভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিকে ধোঁকা দিয়েছিল তার একটা প্রতীকী অনুরণন রয়েছে। একই জিনিসটা হয়েছিল মোহাম্মদ আলী ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের সঙ্গে। আর্জেন্টিনা ফুটবল দল সম্ভবত বাংলাদেশে তাদের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠীর বিষয়ে অবগত। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তারা বাংলাদেশ সফর করেছিল। দর্শকে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের জাতীয় স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে খেলেছিল একটি প্রীতি ম্যাচ। আর্জেন্টিনা ও বার্সেলোনা তারকা লিওনেল মেসি দেশটির মমতা আর ভালবাসা টানতে সমর্থ হয়েছেন। ওই খেলার টিকিট যারা পাননি তাদের জন্য শহরের নানা প্রান্তে বড় স্ক্রিনে খেলাটি সরাসরি সমপ্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকার এ দুই দলের প্রতি পছন্দের গোঁড়ামির মাত্রা এত বেশি যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিশনের সদস্যরা বোঝার চেষ্টা করছেন ইউরোপীয় দলগুলো এত জনপ্রিয় কেন নয়। যদিও দেশটিতে ফুটবল প্রবর্তন করেছিল বৃটিশরা, তারপরও দুঃখজনক হলো রাস্তায় ইংল্যান্ডের পতাকা নেই বললেই চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *