তার ‘অফ দ্য রেকর্ড’ বক্তব্য বিকৃতভাবে প্রকাশ করেছে একটি দৈনিক পত্রিকা। তারপরেও প্রকাশিত ওই ‘বিকৃত’ সংবাদ পড়ে সাংবাদিকরা কষ্ট পেয়ে থাকলে তাদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে নিজের এ অবস্থান তুলে ধরেন শামীম ওসমান।
গত রোববার শামীমকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “সাংবাদিকরা হচ্ছে কুকুর। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন পাড়ার অনেকে পয়সা হলে বাড়িতে কুকুর পুষত। ওদের বাড়ির সামনে গেলে কুকুরগুলো মুখ ভেংচাত। এরপর যাদের আরও পয়সা হলো, তারা মিডিয়া পোষা শুরু করল। এগুলো হলো অ্যালসেশিয়ান কুকুর। প্রশিক্ষিত। লাথি দিলেও এগুলো কামড়াতে আসে।
“যেমন ধরেন, বসুন্ধরার শাহ আলম। ওর আছে চারটা। কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, একটি অনলাইন পত্রিকা আর আরেকটি সান না কী যেন নামের ইংরেজি পত্রিকা। বাবুলের একটা পত্রিকা ছিল, আরেকটা টেলিভিশন নিছে। আজাদ সাহেব, ওনার আগে পত্রিকা ছিল একটা, তার আরেকটা লাগবে। নতুন করে একটি টিভি চ্যানেল নিছে। পত্রিকা আছে একটাই, সেইটা হইলো ইত্তেফাক৷”
এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার এ বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে শামীম ওসমানকে বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানায় সম্পাদক পরিষদ।
সম্পাদকদের ওই আহ্বানের পরদিন এই বিবৃতি পাঠালেন শামীম ওসমান।
এতে প্রথম আলো সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলা হলেও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকদের প্রশংসা করেছেন তিনি।
বিবৃতিতে শামীম বলেন, “জাতির বিবেক শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক বন্ধুরা, আমি অত্যন্ত পরিতাপের সাথে জানাচ্ছি যে, গত ২৯শে জুন দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় আমার উদ্ধৃতি দিয়ে দেশবরেণ্য কিছু ব্যক্তিবর্গ ও সাংবাদিক সমাজকে জড়িয়ে যে আপত্তিকর, অসম্পূর্ণ, মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে আবারো আমাকে হলুদ অপসাংবাদিকতার থাবায় ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে।
“প্রথমেই বলতে চাই, আমি প্রথম আলোকে কোনো সাক্ষাৎকার দেইনি এবং আমি যা বলেছি সবই ছিল অন্য কারো উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বা কোট। আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত বা কোনো সাংবাদিককে ‘কুকুর’ বলে মন্তব্য করার মতো নির্বোধ আমি নই। যারা মহানবী রাসূলে পাক (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি আর ব্যঙ্গ করতে পারে, এমন মিথ্যা মন্তব্য শুধু তারাই করতে পারে। আমার স্বাভাবিক আলাপচারিতা রেকর্ড করে টেম্পারিং করে ঐ মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।”
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতা নিয়ে তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে, গত ২৬শে জুন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে দুটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। কিন্তু সেখানে প্রথম আলোর দুজন সাংবাদিক তাদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করেছিলেন। আমি ঐ মুহূর্তে আমার ভাই সেলিম ওসমান জয়ের পথে থাকায় এতটাই আবেগাপ্লুত ছিলাম যে, উপস্থিত সংবাদকর্মীদের সামনেও আমি আমার আবেগকে ধরে রাখতে পারছিলাম না।
“ঐ সময়ে তাদের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতায় পেশাগত সমস্যা, দুর্ভোগ ও কিছু নেতিবাচক বিষয় নিয়ে কথা উঠলে আমিও তাদের সাথে সমব্যথী হয়ে দেশের ২/৩ জন খ্যাতনামা অগ্রজ সাংবাদিকের সাথে কোনো এক আড্ডার উদাহরণ টেনে বলেছিলাম, ঐ আড্ডায় একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক বলছিলেন, ‘সেই মানিক মিয়া, জহুর হোসেনদের মতো সময় আর নেই। সাংবাদিকতায় নীতি-আদর্শ ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। পত্রিকা আর চ্যানেলগুলো এখন কর্পোরেট হাউস হয়ে গেছে। আগে বড়লোকেরা কুকুর পুষত, এখন পত্রিকা করেন।
“ঐ সাংবাদিক এ সময় আমাকেও বলেন, শামীম ভাই আপনিও দুইটা বের করেন, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে যারা লেখে তখন আপনি তাদের বিরুদ্ধে লিখবেন। আমি তখন বলি, আমার এত টাকা নেই। তখন ঐ সাংবাদিক আমাকে হাসতে হাসতে বলেন, শেফার্ড না পারেন দুটি সরাইলই বের করেন।”
সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় গল্পের ছলে তিনি এসব কথা বলেছিলেন দাবি করে শামীম ওসমান বলেন, “কথোপকথনে আমার নিজস্ব কোনো মতামত ছিল না বা সাংবাদিকদের সম্পর্কে আমার নিজস্ব কোনো মন্তব্যও ছিল না। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কাদঁতে কাদঁতেই বলেছিলাম, আজ এই মুহূর্তে কোনো সাক্ষাৎকার নয়, যা বলছি অফ দ্যা রেকর্ডে।
“খোদ প্রথম আলোই তাদের প্রকাশিত দুটি সংবাদের মধ্যেই স্বীকার করেছে, আমি বলেছি আজ কোন কথা বলবো না, আজ আমি কাঁদবো। আমি তখন অনবরত কাদঁছিলামও। আবার আমার নেতাকর্মীরা যখন আমার কাছে আসছিল তখন আমি তাদের মাথা নিচু করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছি এবং মাথা নিচু করে তা শিখিয়েও দিয়েছি। নির্বাচনটি কতটুকু নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে যে, প্রথম আলোর ঐ প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে-ফলাফল পাল্টে দেয়ার আশঙ্কা করে কিছু হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম।”
আলাপচারিতার সময়ে নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে শামীম বলেন, “তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, দেশ ও জাতির জন্য যারা অবদান রাখছেন সেই বসুন্ধরা গ্রুপের শ্রদ্ধেয় সোবহান ভাই, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় নুরুল ইসলাম বাবুল ভাই, বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান ভাই কিংবা আজাদ ভাই, যাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কথা অনেকেই জানেন, তাদের ব্যাপারে অর্বাচীনের মতো মন্তব্য করা কিংবা সাংবাদিকদের সামনেই সকল সাংবাদিকদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করার মতো নির্বোধ আমি শামীম ওসমান কি না তা একটিবারের জন্য ভেবে দেখুন।
“আমি নিশ্চিত যে, আমার স্বাভাবিক আলাপচারিতা রেকর্ড করে টেম্পারিং করে ঐ মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।”
বিবৃতিতে শামীম ওসমান বলেন, “কেন প্রথম আলোর এই মিথ্যাচার এবং সাংবাদিক সমাজের বিপক্ষে আমাকে দাঁড় করানো হলো সেই কারণ বলতে চাই।
“নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় আমাকে ‘খুনি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রথম আলোর প্রকাশিত একটি সংবাদের বিরুদ্ধে আমি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলাম- কোন সূত্রের মাধ্যমে তারা আমাকে খুনি বলে আখ্যা দিয়েছে তা জানাতে। নোটিশের জবাবে প্রথম আলো জানায়, সাংবাদিকতার নীতিমালায় ‘সূত্র’ প্রকাশ করা যায় না। আমি পরবর্তী নোটিশে বলেছি, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
“আমি যদি সত্যিকারভাবেই অপরাধী হয়ে থাকি, বা প্রথম আলোর ভাষায় ‘খুনি’ হয়ে থাকি তবে ঐ সূত্রের ব্যাপারে আমাকে না জানালেও আমার অভিভাবক জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারকে জানানো হোক। তাকেও না জানানো হলে আমি পরবর্তী নোটিশ দিয়ে বলেছিলাম, মাননীয় স্পিকারকে জানাতে সমস্যা থাকলে যিনি সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তা জানানো হোক।
“সবশেষে যারা এই পত্রিকাটির ডিক্লারেশন দিয়েছেন, সেই ঢাকা জেলার প্রশাসক ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আইনি নোটিশ প্রেরণ করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যেন তারা আমাকে ঐ সূত্রের ব্যাপারে অবগত করেন নতুবা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অন্যথায় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জেলা প্রশাসক ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেই মামলা করব। প্রথম আলো যখন বুঝতে পেরেছে আমি বিষয়টি নিয়ে শক্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছি তখনই তারা এই মিথ্যা, বানোয়াট, নীতি বিবর্জিত সংবাদ প্রকাশ করে পুরো সাংবাদিক সমাজকে ক্ষিপ্ত করেছে।”
শামীম ওসমান বলেন, “যেসকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সকল সময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে আমাকে উপকৃত করেছেন, সাহস যুগিয়েছেন, যাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে তাদেরকেই এবার আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। প্রথম আলো ও তাদের সহযোগী ডেইলি স্টারের এই চরিত্র নতুন নয়। কারণ, মহানবী রাসূলে পাক (সা.) কে নিয়ে ব্যঙ্গ করার পর ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মুসলামানের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেশের প্রতিথযশা সম্পাদকদের সাথে নিয়ে জাতীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে তওবা করেছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক।
“ঠিক একইভাবে হাই কোর্টের ব্যাপারেও যখন প্রথম আলো ফেঁসে গিয়েছিল তখনও সাংবাদিক সমাজকে জড়িয়ে রক্ষা পেয়েছিল। এখন আমার এই আইনি প্রক্রিয়ার শক্ত অবস্থানের কারণেই মিথ্যাচারের আশ্রয়ে এই কল্পনাপ্রসূত বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমি জাতির বিবেক সাংবাদিক সমাজের কাছে আহ্বান জানাতে চাই, এদেশে প্রথম আলোর মতো হলুদ সাংবাদিকতার যেমন দৃষ্টান্ত রয়েছে, তেমনি গোলাম সরোয়ার, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তোয়াব খান, নাইমুল ইসলাম খান, শাহজাহান সরদার, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, সাইফুল আলম, নঈম নিজাম, পীর হাবিবুর রহমান, স্বদেশ রায়, শ্যামল দত্তদের মতো সৎ, প্রকৃত আদর্শবান সাংবাদিকরাও এদেশ ও জাতির কাছে উদাহরণ।
“আমি দেখলাম অনেকেই বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমি বলতে চাই, আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী নয়, বরং এই সকল সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিক ভাইদের কাছে আমার আহ্বান, নারায়ণগঞ্জে আসুন অথবা আপনাদের সমন্বয়ে টিম প্রেরণ করুন। কোথাও যদি আমার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অপরাধের প্রমাণ পান, তবে আপনারা জাতির দর্পণ, আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি তা মাথা পেতে নেব।
“পাশাপাশি আপনাদের কাছেই আমি হলুদ অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। কারণ, আমার সাধারণ আলাপাচারিতা, ‘অফ দ্যা রেকর্ড’ বলার পরেও অডিও রেকর্ড টেম্পারিং করে তা বানোয়াট নিউজ আকারে প্রকাশ করে সাংবাদিকতার নীতিমালাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।
“পরিশেষে আমি বলতে চাই, আমি অপরের উদ্ধৃতি দিয়ে যে কথা বলেছিলাম সেদিনের কথায় যদি সাংবাদিক সমাজ আমার এই ব্যাখ্যার পরে বিন্দুমাত্র মানসিক কষ্ট পেয়ে থাকেন, তবে আমি সকলের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনাদের কাছে ন্যায়বিচার আশা করছি।”