১৯৮৬ বিশ্বকাপটা ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনাময়। এই কিংবদন্তির জাদুর পরশে দ্বিতীয়বার শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। গৌরবময় সেই যাত্রাপথে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের ফুটবলাররাও বাধা হতে পারেননি ম্যারাডোনার। সেমিফাইনালে তাঁর দুই গোলেই চোখের জলে ভেসে বাদ পড়েছিল বেলজিয়াম। সেই বেলজিয়ামকে ২৮ বছর পর আরো একবার বিশ্বকাপে পেল আর্জেন্টিনা। এবার ম্যারাডোনা নেই তাতে কী, লিওনেল মেসি আছেন না? ম্যারাডোনার মতোই এবার মেসির কাঁধে চেপে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা। চার ম্যাচে চার গোল পাওয়া মেসির জাদুকরী পাসে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে স্বস্তির গোল পেয়েছেন আনহেল দি মারিয়া। সেই মেসির মুখোমুখি হওয়ার আগে অবশ্য ভয় পাচ্ছেন না বেলজিয়াম কোচ মার্ক উইলমটস। বরং আর্জন্টিনাকে ‘ভারসাম্যহীন’ দল বলে খোঁচা দিয়ে রাখলেন তিনি, ‘জানি খুবই কঠিন প্রতিপক্ষ আমাদের সামনে। তবে ভালো খেলেই এসেছি কোয়ার্টার ফাইনালে আর থেমে যেতে চাই না এখানে। আর্জেন্টিনা ভালো দল হলেও ওদের ভারসাম্য নেই। আমরা সেমিফাইনাল খেলতে চাই, আশা করছি পারব সেটা।’ ১৯৮৬ সালে অবশ্য কোয়ার্টার ফাইনাল নয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম। এনজো শিফো, ইয়ান কিউলমেনস, এরিক গেরেতস, ইয়ান মারি পাফদের সোনালি প্রজন্মের সেরা সাফল্যই ছিল ‘৮৬-র সেমিফাইনালে পৌঁছানো। তবে ম্যারাডোনা নামের রূপকথার রাজকুমারকে আটকানোর মন্ত্র জানা ছিল না তাদের। এই ম্যারাডোনার জাদুতে শেষ পর্যন্ত ০-২ গোলে হেরে বসে বেলজিয়াম। বিরতির আগে অবশ্য আর্জেন্টিনাকে আটকে রেখেছিল ইউরোপের সম্ভাবনাময় দলটি। ৫১ মিনিটে পারেনি আর। বুরুচাগার পাসে আর্জেন্টিনকে এগিয়ে দেন ম্যারাডোনা। ৬৩ মিনিটে ম্যারাডোনার আরেক অসাধারণ গোলে ২-০ ব্যবধানের জয়ে ফাইনালে পৌঁছে আর্জেন্টিনা। সেমিফাইনালে যাত্রা থামলেও সেরা গোলরক্ষক হিসেবে সেই বিশ্বকাপের সেরা একাদশে জায়গা পেয়েছিলেন বেলজিয়ামের ইয়ান মারি পাফ। ‘৮৬-র সেই হৃদয়ভাঙা হারের পর টানা চারটি বিশ্বকাপ খেলেছে বেলজিয়াম। কেবল ১৯৯৮ ছাড়া অন্য তিন আসরের দ্বিতীয় রাউন্ডেও পৌঁছেছিল তারা। এরপর সোনালি প্রজন্মের খেলোয়াড়দের অবসরে দেখা দেয় প্রতিভার আকাল। তাতেই ১২ বছর বিশ্বকাপের বাইরে বেলজিয়াম। ব্যর্থতার বৃত্তটা ভেঙেছে নতুন প্রজন্ম। ভিনসেন্ট কম্পানি, থিবো কোর্তোয়া, এডেন হ্যাজার্ড, মারুয়ান ফেলাইনি, রোমেলু লুকাকুদের হাত ধরে ১২ বছর পর আবারও বিশ্বকাপের রঙিন আঙিনায় ‘লাল শয়তান’ খ্যাত বেলজিয়াম। প্রত্যাবর্তনটা তারা স্মরণীয় করেছে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে। গ্রুপ পর্বে আলজেরিয়াকে ২-১, রাশিয়াকে ১-০ আর দক্ষিণ কোরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল তারা। দ্বিতীয় রাউন্ডে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে ২-১ গোলে হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। এবার সামনে শিরোপাপ্রত্যাশী আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি নামের জাদুকর বিশ্বকাপটা জিতিয়ে মুখিয়েই আছেন অমরত্বের পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে। তবে ভয়ে কুঁকড়ে নেই বেলজিয়ামও। মেসিদের জন্য প্রস্তুত বলে প্রত্যয়ই ঝরল বেলজিয়ান কোচ মার্ক উইলমটসের কণ্ঠে, ‘জানতাম কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে হবে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। ওরা খুবই শক্তিশালী। মেসিকে নিয়েও আলাদা করে কিছু বলার নেই। তবে আর্জেন্টিনায় শুধু মেসিই নয়, রয়েছে ম্যাচ জেতানো অনেক খেলোয়াড়। আমরা প্রস্তুত। বাদ পড়তে চাই না কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। আমাদের নতুন প্রজন্ম নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বেলজিয়ামকে। ১৯৮৬ সালের দলের সঙ্গে এদের তুলনা করার সময় হয়নি এখনো। তবে এই দলের সম্ভাবনা অনেক বেশি।’ ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আগে বেলজিয়াম ইউরোপিয়ান মহাদেশীয় আসর ইউরোর ফাইনালে পৌঁছেছিল ১৯৮০ সালে। কিন্তু রুমেনিগের পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনাল শেষের দুই মিনিট আগে গোল হজম করে হারতে হয়েছিল ১-২ ব্যবধানে। সেই দল ১৯৮২ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বাদ পড়লেও গ্রুপ পর্বে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। ডিয়েগো ম্যরাডোনাকে রুখতে পেরেছিল তারা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে অবশ্য পেরে উঠেনি। সেবারের ফেভারিট সোভিয়েত ইউনিয়নকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ৭ গোলের ম্যাচে হারিয়েছিল বেলজিয়াম। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইগর বেলানোভের হ্যাটট্রিকের পরও জিতছিল ৪-৩ গোলে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনকে হারায় টাইব্রেকারে। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার সঙ্গে পেরে না ওঠা বেলজিয়াম তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ২-৪ গোলে হেরেছিল ফ্রান্সের কাছে। আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতার পর ম্যারাডোনার কাঁধে চড়ে ফাইনালে পৌঁছেছিল ১৯৯০ বিশ্বকাপেও। তবে ম্যারাডোনা যুগ শেষে বিশ্বকাপে আর নিজেদের ছাপ রেখে যেতে পারেনি লাতিন পরাশক্তিরা। শিরোপা পরের কথা, পার হতে পারেনি কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি। ১৯৯৮-র পর ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপে শেষ আটেই শেষ হয়েছে আর্জেন্টিনার অভিযান। এবারও তাদের সেখানেই থামাতে চান বেলজিয়ান কোচ মার্ক উইলমটস, ‘কোচিং স্টাফরা কাজ করবে আর্জেন্টিনার দুর্বলতাগুলো বের করে ওদের আটকাতে। মেসি, হিগুয়েইনদের আক্রমণগুলো রুখতে আমাদের বড় হাতিয়ার ভিনসেন্ট কম্পানি। ইউরোপিয়ান ফুটবলে ওর অভিজ্ঞতা কাজে আসবে তরুণদের।’ এপি –