বিরোধী দলের আন্দোলন মাঠেই মোকাবিলার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মাঠের আন্দোলন মাঠেই দেখা হবে। সংলাপ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হবে। নির্বাচন না করে বিরোধী দল ট্রেন মিস করেছে। এখন তাদের পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বৃটেন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই আসে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক প্রসঙ্গ। ওই বৈঠকে প্রসঙ্গ ছিল গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন। ওই নির্বাচনের বিষয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের হতাশার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রচার করেছে অন্যরকম। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, তিনি বলেছেন, নির্বাচন এখন অতীত। এখন সামনে তাকানোর সময়। নির্বাচন নিয়ে আসলে কি আলোচনা হয়েছিল বৈঠকে? জবাবটা প্রধানমন্ত্রী নিজেই দিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে তো আলোচনা হবেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এসব আলোচনায় আসতেই পারে। তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, তা অত্যন্ত সত্য কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের দেয়া আনুষ্ঠানিক বিবৃতির কথাও উল্লেখ করেন তার বক্তব্যে। বলেন, তাদের ওয়েবসাইটে এসেছে কি একটা। কিছু দল, কিছু মিডিয়া এটিকে খণ্ডিতভাবে প্রচার করছে। পরে যা বলেছেন তা তো তারা বলেনি। উনি তো (ডেভিড ক্যামেরন) বলেননি নির্বাচন নাকচ। বা আপনি প্রধানমন্ত্রী না। হলে তো আমাকে দাওয়াতই দিতেন না। ঘরের বদনাম বাইরে দিয়ে তারা কি করতে চায়? ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে দেশে শান্তি এসেছে এটি তাদের ভাল লাগছে না। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বৃটেন সফরের বাইরেও আলোচনায় আসে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিরোধী দলের আন্দোলনের হুমকি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি জানিয়েছেন, যেভাবেই হোক একটা নির্বাচন হয়েছে। মানুষ তা মেনে নিয়েছে। ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। এখন সরকারের দায়িত্ব দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আগামী নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এক প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনার পিতার হত্যাকারী, আপনাকে হত্যাচেষ্টাকারী- কারও সঙ্গে কি আপনি সংলাপ করবেন? আমাকে সংলাপ করতে বলেন, আমি যখন ফোন করলাম তখন ফোন ধরতে ছয় ঘণ্টা লাগলো। বলা হলো ফোন নষ্ট। ফোন নষ্ট হলে কি রিং হয়? আমি কাদের সঙ্গে সংলাপ করবো? যারা ১৫ই আগস্ট জন্মদিনের উৎসব করে তাদের সঙ্গে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন সবাই সংলাপ সংলাপ বলছে। রাষ্ট্র চালাতে ব্যর্থ হলে তা না হয় হতো। তা তো হয়নি। আমরা তো দেশ চালাচ্ছি।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশে শান্তি ফিরে এসেছে। একটি শ্রেণীর এটি ভাল লাগে না। দেশে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল আছে। বিদ্যুতের সমস্যা নেই। মানুষ স্বস্তিতে আছে। মানুষ খুশি। কিন্তু খুশি নন গোটা কয়েক মানুষ। তারা চেয়েছিলেন থাইল্যান্ডের মতো পরিস্থিতি হোক। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আসুক। এলে হয়তো তাদের গাড়িতে পতাকা উড়বে।
ঈদের পর বিরোধী দল আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে, এ প্রশ্নে সরকারের অবস্থান কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্ব মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করা। মানুষের নিরাপত্তা দেয়া। নির্বাচনের আগে তারা মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। বাস পুড়িয়েছে। লঞ্চে আগুন দিয়েছে। তারা যদি এমন আন্দোলন করে তাহলে কি আমরা বসে বসে দেখবো? তিনি বলেন, আন্দোলন করতে তারা মাঠে নামুক না। মাঠের দেখা মাঠেই হবে। ফুটবল খেলা মাঠেই হয়। সংসদে এখন যারা অপজিশন আসে তারা তো খিস্তিখেউড় করে না। মাইক ভাঙে না। বিএনপির ক্ষমতায় আসা মানেই তো যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় আসা। কিছু পত্রিকা লিখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। আবার তারাই বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে চায়। তাদের এই দ্বৈত নীতি কেন? বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নূর (নূর চৌধুরী) কানাডায়, রাশেদসহ (রাশেদ চৌধুরী) কয়েকজন আমেরিকায়। এটা তাদের (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) ওপর নির্ভর করছে। তারা গণতান্ত্রিক দেশ। নির্বাচন হলো কি হলো না- তা তারা নিক্তি দিয়ে মাপে। আবার খুনিদের আশ্রয় দেয়। এটাই তাদের নীতি।
আলোচনা আছে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের আঁতাত হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, আঁতাতের রাজনীতি আমরা করি না। জামায়াতের কাছে যাওয়ার আমাদের কি আছে? যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিচার হচ্ছে। এতে আমাদের হাত নেই। কাউকে ধরে এনে বিচার তো আমরা করতে পারি না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। একজন সাংবাদিক বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম উল্লেখ করে বিদেশে অবস্থান করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তোলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কি আছে? অনেক মামলা আছে। এখন হয়তো সময় হয়েছে আর একটু দ্রুতগতিতে এসব চালিয়ে নেয়ার। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওমরাহ পালনের সময়ে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) প্রেসিডেন্ট আহম্মেদ মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এ সময় তারেক রহমান সেখানে ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, এটা তো তাদেরকেই (আইডিবি) প্রশ্ন করতে হবে। একজন ফেরারি আসামির সঙ্গে দেখা করে তারা কতটা স্বস্তিবোধ করলেন? বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ এনে একজন সাংবাদিক জানতে চান আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে এটি আপনার বক্তব্যে স্পষ্ট করেননি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামনের নির্বাচন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হবে। যারা অসাংবিধানিক কিছু চায় তাদের কাছে আমার বক্তব্য স্পষ্ট লাগবে না। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের কাছে আমার বক্তব্য স্পষ্ট।
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে থাকা উচিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সামরিক শাসকরা করেছিল। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে এটি খাপ খায় না বলেই আলোচনাটা উঠেছে। হওয়াটাও সমীচীন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করেন। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা পরে দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দিয়ে ক্ষমতায় বসে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। ইতিমধ্যে জিয়ার শামনামলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরে আমরা একটি সর্বদলীয় বিশেষ কমিটি করে সংবিধান সংশোধন করি। তখনও বিষয়টি উঠে এসেছিল। বর্তমানে আইন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ অনেকে মতামত দিয়েছে। যেহেতু দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারা চলছে, সেজন্য ’৭২-এর সংবিধানের ধারা ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের প্রতিনিধিদের হাতেই ক্ষমতা থাকা উচিত। ‘আরেকটি ১৫ই আগস্ট হতে পারে’ -বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমন বক্তব্য দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করছেন- তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা? একজন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই হুমকির মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান ও তার পরিবার জড়িত। তারা হত্যার পরিকল্পনা করেই এ ধরনের হুমকি দেয়। অতীতেও এ ধরনের হুমকির পরে আমার ওপর আঘাত এসেছে। একবার নয় বারবার। কিন্তু আমি এসব হুমকিতে ভয় পাই না। জন্মেছি যখন মরতে হবেই। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। কিন্তু মরার আগে আমি মরি না। তিনি বলেন, আমার হারানোর কিছু নেই, দেশের জন্য আমার কাজ আমি করে যাবো, কোন হুমকিই আমাকে থামাতে পারবে না। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের খোঁজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোন স্টেশন বা টার্মিনাল পরিদর্শনে যাবেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমি সব সময় রাস্তার খবর পাই। আমার লোক তো রাস্তায় আছে। মন্ত্রী তো রাস্তায় হাঁটছে। সব খবরই আমি পাই। আর আমি তো বেরই হই না। কারণ, বের হলে রাস্তা আটকালে মানুষেরই কষ্ট হবে।
সংবাদ সম্মেলনে দুই পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তার বৃটেন সফরের বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সফর অত্যন্ত সফল ও ফলপ্রসূ হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তার বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তার মাগফেরাত কামনা করেন।
অন্যান্যের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন।