নাড়ির টানে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। গত কয়েক দিন ধরেই শুরু হয়েছে ঘরমুখো মানুষের মিছিল। রেল, বাস আর লঞ্চঘাটে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। নানা প্রতিকূলতা সঙ্গী করেই বাড়ি ছুটছেন তারা। মানুষের চাপ কমায় গতকাল রাজধানীতে যানজট বলতে গেলে ছিুল না। তবে ঘরমুখো মানুষদের ভিড়ের কারণে যানজট ছিল রেল স্টেশন, লঞ্চঘাট ও বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। ট্রেনের বগি যেমন খালি ুেনই, তেমনি খালি ছিল না ট্রেনের ছাদও। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ট্রেনের ছাদে উঠে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করেছেন অনেকে। কাঙ্ক্ষিত সময়ের বাস ও ট্রেনের টিকিট না পেয়ে অনেকে বাড়িতে যাত্রার সময়ও পিছিয়েছেন। গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশন, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড ও সদরঘাট লঞ্চঘাট ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র। কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষের মিছিল। বাড়ি ফেরার আনন্দ ছিলো তাদের চোখে-মুখে। কিন্তু তাতে বাদ সাধে সিডিউল বিপর্যয়। দুপুর ১২টায় কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে সিলেটের উদ্দেশে যাওয়ার কথা আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের। কিন্তু দুপুর ২টা পর্যন্ত প্লাটফর্ম ছাড়তে পারেনি ট্রেনটি। তথ্যকেন্দ্র থেকে বারবার বলা হচ্ছে ‘অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা কমলাপুর স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে জয়িন্তকা।’ কিন্তু এই কিছুক্ষণ কখন শেষ হবে তা জানতেন না জয়ন্তিকার জন্য অপেক্ষামাণ যাত্রীরা। শুধু জয়ন্তিকা না গতকাল অনেক ট্রেনই সিডিউল অনুসারে কর্তৃপক্ষ ছাড়তে পারেননি। এর মধ্যে রাজশাহী এক্সপ্রেসের সিডিউল বিপর্যয় নিয়ে রহস্যময় ভূমিকা পালন করেন কমলাপুর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে কমলাপুর থেকে ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ২টা পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনের ইঞ্জিনে অগ্নিকাণ্ড ঘটায় ট্রেনটি সিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তবে কে বা কারা ট্রেনে আগুন দিয়েছে তা জানা যায়নি। এ ব্যাপারে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার সাখাওয়াত হোসেন কোন মন্তব্য করেননি। তবে অগ্নিসংযোগের বিষয় স্বীকার করে স্টেশন ম্যানেজার খায়রুল বশীর বলেন, দুর্ঘটনার কারণে রাজশাহী এক্সপ্রেসের সিডিউল ঠিক থাকেনি। এছাড়া ট্রেনের ইঞ্জিন চেকিংসহ নানা কারণে ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখা যায়নি।
জয়ন্তিকা, রাজশাহী এক্সপ্রেস ছাড়াও সুন্দরবন এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস, ঈশা খাঁ, কুমিল্লাগামী কমিউটার ট্রেন সিডিউল অনুযায়ী কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যায়নি।
সকাল ৯টায় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাড়ার কথা ছিল চট্টলা এক্সপ্রেসের। কিন্তু এক ঘণ্টা দেরিতে স্টেশন ছাড়ে এ ট্রেনটি। এরপর আর কোন ট্রেনেরই সিডিউল ঠিক রাখতে পারেননি কর্তৃপক্ষ। যদিও জয়ন্তিকা ও রাজশাহী এক্সপ্রেস ছাড়া অন্য ট্রেনগুলোর দেরি হওয়াকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন কমলাপুর স্টেশন কর্তৃপক্ষ। তাদের মতে, এক থেকে দু’ঘণ্টা দেরি হওয়াটা স্বাভাবিক। ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মে বসে অপেক্ষায় ছিলেন যাত্রীরা। দুপুরে কথা হয় সিলেটগামী জয়ন্তিকার যাত্রী রুহান আহমদের সঙ্গে। রুহান বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে অগ্রিম টিকিট কিনেছি। অথচ এখন স্টেশনে বসে আছি। কখন ট্রেন ছাড়বে তার কোন হদিস নেই।
রুহানের মতো ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পাফনতে কর্মরত ইউসুফ হোসেন ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে অপেক্ষায়। তিনি যাবেন রাজশাহী। জানালেন, স্ত্রী গাড়িতে দীর্ঘ সময় চড়তে পারেন না। বমি আসে। তাই ট্রেনে যাওয়া। বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করবেন এ নিয়ে মনের মধ্যে আনন্দ থাকলেও সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে আনন্দ মাটি হয়ে যাচ্ছে এই দম্পতির। দেখা গেছে, অগ্রিম টিকিট যারা সংগ্রহ করতে পারেননি তাদের অনেকেই স্ট্যান্ডিং টিকিট নিয়ে ট্রেনে যাত্রা করছেন। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, টিকিট পাননি এমন যাত্রীদের জন্যই এই সুবিধা। সিট না পেলেও তারা গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন। ট্রেনের টিকিট নেই তবু অনেকেই ভিড় করছেন স্টেশনে। স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করে গন্তব্যে যাচ্ছেন তারা। সিট নেই তবু কষ্টের এই যাত্রা আনন্দের। এত কিছুর পরে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করা যাবে। সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ঘণ্টার ঘণ্টা তারা বসে আছেন স্টেশনে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়।
লাইনে দাঁড়িয়ে রেলের অগ্রিম টিকিট পাননি অনেকেই। বাধ্য হয়েই তারা ছুটছেন বাস স্ট্যান্ডে। গতকাল দেখা গেছে, গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভিড়। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় যাত্রী মাসুদ আলমের সঙ্গে। বললেন, রাজশাহী যাওয়ার জন্য টিকিট চেয়েছিলাম ২৭ জুলাইয়ের। কিন্তু পাইনি। তাই পরের দিনের টিকিট সংগ্রহ করেছি। ভাড়া ৩০ টাকা বেশি নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সায়েদাবাদের একজন পরিবহন কর্মকর্তা বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান এরকম বাড়তি ভাড়া আদায় করে। তবে তা মাত্রা-অতিরিক্ত না। কথা হয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সদরঘাটে অপেক্ষমান সোহাগ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি বলেন, টিকিট পাচ্ছি না। কিন্তু বাড়ি যেতেই হবে। বাড়ি যেতে একদিন লাগলেও সমস্যা নেই। তারপরও বাড়ি যেতে পারলেই শান্তি বলে জানান তিনি।
ঈদ উপলক্ষে বাড়তি আয় করতে গিয়ে লঞ্চগুলো ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি যাত্রী নিয়ে যাত্রা করছে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবগত থাকলেও কোন ভূমিকা নেই তাদের। এদিকে, প্রতিটি রুটে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত বিরামহীনভাবে বাস সার্ভিস সচল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট ও প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা ছিল লক্ষ্যণীয়।