সাংবাদিকদের অনৈক্য, ফায়দা রাজনীতিকদের

43b5abf4660df157f7c59791cc0efbcd-1সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে অংশগ্রহণকারী দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং ব্রিটেন সফরের অন্য দিকগুলো নিয়ে ২৬ জুলাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, তার পুরো ভিডিওটি প্রথম আলো অনলাইনের কল্যাণে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। পরের দিন মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের মালিকানাধীন পত্রিকায় ওই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা কে কী প্রশ্ন করেছিলেন, তার হুবহু বিবরণ প্রকাশ করে (ইত্তেফাক, ২৭ জুলাই ২০১৪)। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকদের এসব প্রশ্ন এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় তোলে।
ওই সব সমালোচনার লক্ষ্য ছিলেন সাংবাদিকেরা, তাঁদের দলীয় আনুগত্য প্রকাশের প্রতিযোগিতা এবং প্রধানমন্ত্রীর তুষ্টিসাধনের দৃষ্টিকটু ও অপেশাদার আচরণ। ধারণা করি, পত্রিকাটির বার্তা বিভাগের কর্তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংবাদিকদের শিক্ষা কার্যক্রমে দলকানা সাংবাদিকতা কাকে বলে এমন একটি বিষয়বস্তুর নমুনা হিসেবে ওই সব প্রশ্নের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তা আলাদাভাবে প্রকাশ না করে পারেননি। সেই প্রতিযোগিতায় এমনকি আমার পূর্বতন প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনও (বিবিসি) বাদ যায়নি।
গার্ল সামিটের অর্জনের জন্য বিবিসি বাংলার ওই সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডে বিবিসির কোনো সাংবাদিক যদি প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনকে এ রকম অভিনন্দন জানাতেন, তাহলে পরের দিন তাঁকে আর কর্মস্থলে ফিরতে হতো না। এমনকি, কথিত নিরপেক্ষ সম্পাদকদের মধ্যে যখন দেখি যে কারও প্রধান কৃতিত্ব দাঁড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেলফি (মোবাইলে এক ফ্রেমে ছবি তোলা) তুলে তা ফেসবুকে প্রকাশ করা; তখন পেশাদারত্বের অবনতি দেখে মনে হয়, পেশাটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো ছিল। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেসব পরামর্শ ও দাবি তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো থেকে যে কারোরই ধারণা হতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী আসলে তাঁর বিরোধীদের হুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট কঠোর নন। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী যদি এরপর গণমাধ্যমসহ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী হন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
ওই সংবাদ সম্মেলনের সপ্তাহ খানেক আগে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি অংশের এক ইফতার মাহফিলে অংশ নিতে যান। ইফতারের পর জাতীয় প্রেসক্লাবে তিনি সাংবাদিকনেতাদের সঙ্গে কিছু মতবিনিময়ও করেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী সে সময় একজন সাবেক নেতা লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রেস মিনিস্টার পদে নিয়োগের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, দলের প্রতি আনুগত্যের সন্তোষজনক প্রমাণ নেই, এমন একজনকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয় যে ইউনিয়নের ওই অংশের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা অভিযোগ করেন, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে সাংবাদিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত নেওয়া হয় না।
লাভজনক রাষ্ট্রীয় পদ পাওয়ার জন্য দলীয় আনুগত্য প্রমাণের এই প্রতিযোগিতা অবশ্য শুধু আওয়ামী লীগের একক অধিক্ষেত্র নয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের সময়ও এমনটিই ঘটেছে এবং তারা ক্ষমতার বাইরে থাকলেও দলীয় আনুগত্যই তাঁদের অনেকের কাছে মুখ্য বিষয়। সুতরাং, রাজনৈতিক বিভাজনের হুবহু প্রতিফলন সাংবাদিক ইউনিয়নেও প্রকট। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে এই বিভাজনের দুই পারে থাকা নেতারা সাময়িক কিছুটা সমঝোতার নজির স্থাপন করলেও জাতীয় অঙ্গনে রাজনৈতিক বিরোধ তীব্রতর হতে থাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব আবারও প্রসারিত হয়েছে।
সাংবাদিকদের দলীয় আনুগত্যের সাম্প্রতিক একটি নজির স্থাপিত হয়েছে রাশিয়ায়। ২৯ জুলাই মস্কো টাইমস জানিয়েছে যে রাশিয়ার ফার ইস্ট-এর একদল সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘রাশিয়ার নায়ক’ (হিরো অব রাশিয়া) অর্পণ করার জন্য সেখানকার পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি একটি মালয়েশীয় যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করার জন্য অভিযুক্ত ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও বিতর্কিত মি. পুতিনের সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যখন একের পর এক অবরোধ আরোপের কথা ঘোষণা করছে, তখন এসব সাংবাদিক তাঁকে তোষণের জন্য এতই ব্যাকুল যে রাজনীতিকেরা যে ভাবনা ভাবেননি, তাঁরা সেটাই তুলে ধরেছেন। রুশ রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট পুতিনের যে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, তুলনা করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা তার চেয়ে কম কিছু নয়। সুতরাং ক্ষমতাবন্দনার ধারায় ভবিষ্যতে কখনো কিছু মিলে গেলেও মিলতে পারে।
অবশ্য, দলীয় আনুগত্যের কারণে পেশার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সাংবাদিকদের অনৈক্য ভুলে সংহত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *