দীর্ঘ একটা সময় কলকাতার কোন নায়কের ছবি বাংলাদেশে চলতো না। প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, অভিজিৎ থেকে শুরু করে জিৎ-এর ছবি পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখতে চাননি। কলকাতার নায়িকারাও এ দেশে ব্যর্থ হয়েছেন একমাত্র ঋতুপর্ণা ছাড়া। ঋতুপর্ণা বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয় করে দর্শক মন জয় করেছেন। যৌথ প্রযোজনার ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র মাধ্যমে দর্শকদের ভালবাসা পেয়েছিলেন প্রিয়াংকা ত্রিবেদী। আর কারও ক্ষেত্রেই এমনটি জোটেনি। এমনকি মিঠুন চক্রবর্তী ছাড়া মুম্বইয়ের অন্য নায়কেরাও খুব বেশি দর্শক হৃদয়ে দাগ কাটতে পারেননি। চাঙ্কিপান্ডে, শরদকাপুর, রনিত রায়সহ অনেকেই যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে এ দেশের দর্শকদের সামনে এসেছিলেন। ভারতীয় সিনেমা কিংবা ভারতীয় নায়ক-নায়িকারা এ দেশে চলবে না, এমন ধারণা যখন সবার মনে স্থায়ী হয়ে গেল, বিশেষ করে আমদানিকৃত তিনটি কলকাতার সিনেমা- ‘জোর’, ‘বদলা’ ও ‘সংগ্রাম’ নিদারুনভাবে ব্যর্থ হলো তখন ভারতীয় বাংলা ছবি নিয়ে সব আশা শেষ হয়ে যায়। ঠিক তখনই অখ্যাত এক নায়ক অংকুশ অভিনীত ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ বাংলাদেশে মুক্তি পেয়ে দর্শক হৃদয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। অনন্য মামুন ও ভারতের অশোক পতি পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার এই ছবিতে অংকুশের নায়িকা ছিলেন শুভশ্রী। ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ এর দারুণ সাফল্যে বেশ ক’জন প্রযোজক কলকাতার নায়কদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এরই মধ্যে অংকুশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার ‘রোমিও জুলিয়েট’ ছবিতে। অনন্য মামুন ও অশোক পতি পরিচালিত এ ছবিতে অংকুশের নায়িকা থাকবেন মাহিয়া মাহি। কলকাতার আরেক নায়ক হিরণ বাংলাদেশের একটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হতে একদিনের জন্য ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। এ ছবিরও পরিচালক অনন্য মামুন। ছবিটি প্রযোজনা
করবেন আনোয়ার হোসেন মিন্টু। হাতিরঝিলে কেক কেটে ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হন হিরণ। অংকুশ কিংবা হিরণ কারোরই টালিগঞ্জে বেশি ছবি করার রেকর্ড নেই। নেই দেব, জিৎ-এর মতো ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তারপরও ঢাকার প্রযোজকরা কলকাতার নায়কদের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন কেন এটা সাধারণ প্রশ্ন? খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে বের হয়ে এলো কিছু অসাধারণ তথ্য। শাকিব খান এবং তার পরবর্তী নায়কদের অশিল্পীসুলভ আচার-আচরণ, যোগ্যতার তুলনায় অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবি এবং কাজের তুলনায় অকাজে বেশি মাত্রায় মনোযোগী হয়ে ওঠার কারণে প্রযোজকরা তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তাদের পেশাই কেবল ছবি বানানো কিংবা ছবি বানানোর বাইরে যারা আর কিছুই করেন না। তারা বাধ্য হয়ে ছুটছেন কলকাতায়। নিচ্ছেন অংকুশ, হিরণ, ইন্দ্রনীলদের। তাদের সামনে ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’। ছবি ভাল হলে দর্শক নায়ক-নায়িকা দেখে না এই ছবি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আবার ছবি ভাল না হলে এ দেশের বড় বড় তারকারাও ব্যর্থ হয়েছেন তার উদাহরণ ভূরি ভূরি। গেল ৫ বছরে চলচ্চিত্রের সুসময় দুঃসময় দু’টোই শাকিব খানের হাত দিয়ে শুরু। একটা সময় ছিল শাকিব খান মানেই সুপারহিট। ক’দিন পর সুপারহিট না হলেও হিট। এখন হিট সুপারহিট না হলেও লগ্নিকৃত অর্থ কিছুটা হলেও ফেরত আসে। ফলে শাকিব খান টিকে আছেন লড়াইয়ে। তবে তিনি সুপারস্টার হওয়ার পরে যে পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন, এখনকার তিনজন নায়ক সেই পথে হাঁটা শুরু করেছেন স্টার হওয়ার আগেই। ক্যারিয়ারে সফল ছবি মাত্র একটি। অথচ আরেফিন শুভ ১০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক হাঁকছেন বলে প্রযোজকদের অভিযোগ। খুব বেশি লাভ হয়েছে এমন ছবির সংখ্যা হাতে গোনা অথচ বাপ্পি চৌধুরী পারিশ্রমিক হাঁকছেন ৮ লাখ। আর মাত্র একটি ছবি সফল বাকি সব ব্যর্থ, সেই সাইমন হাঁকছেন ৬ লাখ টাকা। এর বাইরে তিনজন নায়কেরই রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। যে সকল প্রযোজক পরিচালক এদের নিয়ে কাজ করছেন তাদের বেশির ভাগেরই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কেউ কেউ এতটাই বাড়াবাড়ি করছেন, গল্প শোনার মতো সময়ও নাকি দিতে চান না। কেউ কেউ পুরো ইউনিটের সামনে পরিচালকের নির্দেশ অমান্য করেন। আর পছন্দসই নায়িকা বিষয়ক ঝামেলা তো আছেই। এসব কারণে স্বনির্ভর প্রযোজকরা বিরক্ত হয়ে নতুন নায়কের সন্ধান করছেন। কেউ কেউ ছুটছেন কলকাতায়। ফলে কলকাতার অখ্যাত নায়কদের জন্যও কাজের একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ করেই শাকিব খানের আদর্শে পথচলা নায়কদের দরোজা। প্রতিষ্ঠিত প্রযোজকদের হিসাব দু’টো- এক. ঝামেলাই যদি পোহাতে হবে তাহলে শাকিব খানকে নিয়েই পোহাই, ছবি যখনই শেষ হোক, কিছু টাকার নিশ্চয়তা তো পাওয়া যায়। দুই, কলকাতার নায়ক আনা। ছবি ভাল হলে কে নায়ক আর কে নায়িকা দর্শক সেটা দেখে না। প্রযোজকদের যুক্তিতেই শাকিব খানও অর্ধেক জনপ্রিয়তা হারিয়েও কাজ করে চলেছেন। আর ইন্দ্রনীল, হিরণ, অংকুশের মতো নায়কেরা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসছেন। নির্মাতাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে কাজ করছেন। প্রযোজকদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন না। মোট কথা শিল্পীসুলভ আচার-আচরণ আর কাজের ক্ষেত্রে কলকাতার নায়কদের শ্রদ্ধাশীল মনোভাবই বাংলাদেশের প্রযোজকদের আকৃষ্ট করছে তাদের প্রতি। কারণ যারা এখনও চলচ্চিত্রকে ভালবাসেন তারা অর্থ ব্যয় করে কষ্ট আর অসম্মান কিনতে রাজি নন।