অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দোষ স্বীকার না করলেও শাস্তি দিতে পারবেন মোবাইল কোর্টের বিচারক। পাশাপাশি কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা মোবাইল কোর্টের সামনে অনুপস্থিত থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)কে নির্দেশ দিতে পারবেন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। এসব নানা বিতর্কিত ধারা যোগ করে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এ সংশোধনী আনতে যাচ্ছে সরকার। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ সংশোধনের জন্য প্রস্তাবের উপর আলোচনা এবং মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ (সংশোধনী, ২০১৪) এর খসড়া চূড়ান্ত করতে কাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে বসছে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা। এতে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, জনপ্রশাসন, অর্থ এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদেরকে সম্ভব হলে সংশোধনী প্রস্তাবের লিখিত মতামতসহ উপস্থিত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। আমন্ত্রিত কর্মকর্তা ছাড়াও সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীতে আন্দোলন-সংগ্রাম কঠোরভাবে মোকাবিলার হাতিয়ারের অংশ হিসেবে মোবাইল কোর্ট আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে। এমন সংশোধনী আনা হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে গণহারে মামলা হবে। ফলে হরতালের সময় অতীতে যেমন কঠোর ছিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভূমিকা সংশোধনী হলে আরও কঠোর হবেন তারা।
মোবাইল কোর্ট আইনের সংজ্ঞায় পরিবর্তন: মোবাইল কোর্ট আইনের সংজ্ঞায় দুটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনের ২ (১১) নং ধারায় যোগ করা হয়েছে, ‘উদঘাটিত অপরাধ’ বলতে এমন কোন অপরাধকে বুঝাইবে যাহা কোন এক্সিকিউটিভ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উন্মোচিত বা প্রকাশিত হয়েছে। ২(১২) নং ধারায় যোগ করা হয়েছে, ‘চাক্ষুষ ঘটনা’ বলতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালীন এক্সিকিউটিভ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংঘটিত বা উদঘাটিত ঘটনাকে বুঝাবে। সংশোধনী প্রস্তাবের মন্তব্যের কলামে বলা হয়েছে, মূল আইনে উদঘাটিত অপরাধের সংজ্ঞা নেই এ জন্য নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা আবশ্যক এবং চাক্ষুষ ঘটনা শব্দদ্বয় নতুনভাবে যোগ করা হয়েছে বিধায় সংজ্ঞা দেয়া হলো।
স্বীকারোক্তি না দিলেও মোবাইল কোর্টে দণ্ড: বর্তমান মোবাইল কোর্ট আইনের ৬ নং অনুচ্ছেদে মোবাইল কোর্টের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। এ আইনের ৬(১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (১) ধারা ৫-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোন অপরাধ, যা কেবল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তার সম্মুখে সংঘটিত বা উদঘাটিত হয়ে থাকলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, দোষী সাব্যস্ত করে, এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করতে পারবেন। এর বদলে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বর্তমান আইনের সঙ্গে অথবা শব্দটি যোগ করে বলা হয়েছে, (১) ধারা ৫-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ধারা ১১-এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় তফসিলে বর্ণিত আইনের অধীন কোন অপরাধ, যা কেবল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য, তার সম্মুখে সংঘটিত বা উদঘাটিত হয়ে থাকলে তিনি উক্ত অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে অথবা চাক্ষুস ঘটনা, উপস্থিত সাক্ষীদের বক্তব্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচারে এবং তাহার বিচারিক ক্ষমতার সামগ্রিক বিবেচনায় অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে এই আইনের নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করতে পারবেন। এ বিষয়ে মন্তব্যের কলামে বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংঘটিত বা উদঘাটিত অপরাধের বিষয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ অস্বীকার করলে নেয়া আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন বিধান মূল আইনে না থাকায় এ সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওদিকে বর্তমান আইনের ৬(৪) ধারায় বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় যদি কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এমন মনে হয় যে, অপরাধ স্বীকারকারী ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট অপরাধ এমন গুরুতর যে, এই আইনের অধীন নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করা হলে উহা যথোপযুক্ত হবে না, তাহলে তিনি ওই ব্যক্তিকে দণ্ড আরোপ না করে তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরের ব্যবস্থা করবেন। কিছু শব্দ যোগ করে প্রস্তাবিত সংশোধনীর ৬(৪) ধারায় বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় যদি কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এমন মনে হয় যে, অপরাধ স্বীকারকারী অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট অপরাধ এমন গুরুতর যে, এই আইনের অধীন নির্ধারিত দণ্ড আরোপ করা হলে উহা যথোপযুক্ত দণ্ড আরোপ হবে না, তাহলে তিনি ওই ব্যক্তিকে দণ্ড আরোপ না করে তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে পারবেন।
আসামি উপস্থিত না থাকলেও মাফ নেই: মোবাইল কোর্ট আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে ৬(৬) নামে একটি উপধারা যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধারার মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকলেও তার বিরুদ্ধে এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিতে পারবেন মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। প্রস্তাবকৃত উপধারায় বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় যদি এইরূপ কোন অপরাধ এক্সিকিউটিভ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে সংঘটিত হয় বা উদঘাটিত হয় বা প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় কিন্তু অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তাহা হইলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ওই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনুপস্থিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে পারবেন। ওদিকে বর্তমান আইনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা পদ্ধতির ধারায় ৭ (৪) উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংযুক্ত উপধারায় বলা হয়েছে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক অভিযোগ অস্বীকার করে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দিলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চাক্ষুষ ঘটনা, উপস্থিত সাক্ষীদের বক্তব্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং তার বিচারিক ক্ষমতার সামগ্রিক বিবেচনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্তকরতঃ ওই আইনে যথোপযুক্ত দণ্ড আরোপ করে লিখিত আদেশ দেবেন।