কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন উপমহাদেশের অন্যতম নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। গতকাল বেলা ঠিক ১টা ২৭ মিনিটে এই মুকুটহীন নজরুল সম্রাজ্ঞীর নিথর দেহ লাশবাহী ভ্যানে নিয়ে আসা হয় শহীদ মিনার চত্বরে। ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দিবো না ভুলিতে’ স্বকণ্ঠে গেয়ে যাওয়া ফিরোজা বেগমের এই নজরুলগীতিটি তখন মাইকে বাজছিল শেষ বিদায় অনুষ্ঠানে আসা ভক্ত-অনুরাগী-স্বজনদের স্তব্ধ করে দিয়ে। ফিরোজা বেগমের কফিন ঘিরে কান্নার গুমোট আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। বেলা ঠিক ১টা ৫৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর পরই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছায় শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মাহবুবুল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, দীপু মনি, এডভোকেট আবদুল মান্নান খানসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মী। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, গীতিকার-পরিচালক-প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার, কণ্ঠশিল্পী মনির খান, চিত্রনায়ক উজ্জল, হেলাল খান প্রমুখ। এরপর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি ফিরোজা বেগমকে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলাদেশ সাম্যবাদী পার্টির পক্ষ থেকে দিলিপ বড়ুয়া, এলসিএস গিল্ড-এর পক্ষ থেকে সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী, গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী, বামবা’র পক্ষ থেকে ফুয়াদ নাসের বাবু, টিপু, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান, নজরুল সংগীতশিল্পী পরিষদ, বাংলা একাডেমি, ছায়ানট,
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় জাদুঘরসহ অসংখ্য সংগঠন। বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী, প্রাক্তন উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ও ড. ম. তামিম, ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু, বিশিষ্ট
নজরুল সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার, ইয়াসমিন মুসতারী, খালেদ হুসাইন, শবনম মুসতারী, কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, হাশেম খানসহ অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে এই বিদায় অনুষ্ঠানে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো শেষে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার বলেন, যখন শুনলাম ফিরোজা বেগম আর নেই, তখনই আমি জেদ করে বললাম- না উনি আছেন। এই বাংলা, এই দেশ যতদিন থাকবে ততদিনই তিনটি নাম থেকে যাবে। নাম তিনটি হলো- কাজী নজরুল ইসলাম, কমল দাসগুপ্ত এবং ফিরোজা বেগম। ফিরোজা বেগমের খুব কাছে থাকা দেশের অন্যতম নজরুল শিল্পী শবনম মুসতারী বলেন, তার সান্নিধ্যে ছিলাম এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এদিকে ফুলেল শ্রদ্ধা শেষে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে আমরা যতখানি জানতে পেরেছি তার সিংহভাগই জেনেছি ফিরোজা বেগমের মধ্য দিয়ে। এই কথাটি একবাক্যে আমরা সবাই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্বীকার করতে পারি। তাই আজ এই বেদনাবিধূর বিদায় অনুষ্ঠানে আমি একটা কথাই বলবো, এই মানুষটির নামে আমাদের একটা কিছু করা উচিত। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাববার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত এই বিদায় আয়োজনের শেষ প্রান্তে ফিরোজা বেগমের ছোট ভাই বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ আসাফ- উদ-দৌলা বলেন, এমন দিনে কিছু বলার নেই। সবার ভালবাসায় তিনি বিদায় নিচ্ছেন, এটাই ভাললাগা। সম্পর্কে তিনি আমার বড় বোন। তারচেয়েও বড় সম্পর্ক তিনি আমার শিক্ষাগুরু। দোয়া করবেন তিনি যেখানে গেছেন, সেখানে যেন শান্তিতে থাকেন। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকলো। জীবদ্দশায় আমার এই বোনটি যদি কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন আপনারা ক্ষমা করে দিবেন। এদিকে ফিরোজা বেগমের ২য় পুত্র ব্যান্ড তারকা হামিন আহমেদ বলেন, আমার মা অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন। মা হিসেবে আমাদের দিয়ে গেছেন। আর শিল্পী হিসেবে নজরুল সংগীতটাকে ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন সারা দুনিয়ায়। আজ সেই মানুষটির বিদায়ের মধ্য দিয়ে একটি ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটলো। আপনারা আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন। বিদায় অনুষ্ঠানের সবশেষে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা রাখেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, এক একটি শতাব্দী পরে এমন একজন ফিরোজা বেগমকে খুঁজে পায় একটা জাতি। জানি না আবার কত শতাব্দী পেরুলে পরে আরেকজন ফিরোজা বেগমকে খুঁজে পাবে এই বাংলাদেশ। স্বাধীনতার আগে এবং পরে ফিরোজা বেগম গেয়েছেন দেশের জন্য, নজরুল সংগীতের বিকাশের জন্য। তার সৃষ্টি অবিনশ্বর। সমাপনী বক্তব্য শেষে এক মিনিট নীরবতা। নীরবতা ভাঙতেই স্পিকারে বেজে ওঠে ফিরোজা বেগমের গাওয়া অবিনশ্বর গান,
‘আমি চিরতরে চলে যাবো, তবু আমারে দিবো না ভুলিতে’।
গানের কথা ধরেই ফুলের ডালায় মোড়ানো ফিরোজা বেগমের মরদেহবাহী ভ্যান রওয়ানা দেয় গুলশান আজাদ মসজিদের উদ্দেশে। এদিকে এর আগে সকাল সাড়ে আটটার দিকে ফিরোজা বেগমের মরদেহ হাসপাতাল থেকে আনা হয় তার ১৮ বছরের আবাসস্থল ফার্মগেটস্থ কালিন্দ অ্যাপার্টমেন্টে।