সিএসআর নিয়ে চলছে চরম অসন্তোষ। ক্ষোভ, তর্ক-বিতর্ক আর পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি। একই মতাদর্শের শক্তিমান অর্থনীতিবিদরা হচ্ছেন মুখোমুখি। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছেন না। অবশ্য এ খাতে হরিলুটেরও অভিযোগ রয়েছে। সমপ্রতি সিএসআর অপব্যবহারের প্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাষ্ট্রীয় খাতের জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সিএসআর ব্যয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতে ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংক সিএসআরের নামে ভ্রমণ, পাঁচতারা হোটেলের আপ্যায়ন বিল, পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিল, উদ্দেশ্যমূলক পুরস্কার বিতরণ প্রভৃতিতে ব্যয় করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৩ লাখ টাকা শিক্ষাবৃত্তি বিতরণের অনুষ্ঠান বিলাসবহুল হোটেলে আয়োজনের জন্য ১৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রমের নামে যে ধরনের কাজে অর্থ দিয়েছে সেগুলোর অনেকটাই সিএসআর খাতভুক্ত নয়। বিশেষত দেশে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকটি জেলা সমিতিকে প্রদত্ত অনুদান, ব্যাংকের সিবিএ’র বার্ষিক বনভোজনে ব্যয়িত অর্থ, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে দেয়া অর্থ এবং ব্যাংকের দৈনন্দিন কল্যাণমূলক ও বিজ্ঞাপন ব্যয় সিএসআর খাতে দেখানো হয়েছে। সিএসআর খাতভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় (স্পন্সর) অর্থ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেয়া অনুদান এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন, শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, গণকবর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রভৃতি কমিটিকে দেয়া টাকার সদ্ব্যবহার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশয় রয়েছে। পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামী উইং পরিচালনার জন্য ইসলামী শরিয়াহ বোর্ডকে অর্থ দেয়া হয়েছে, অথচ তা সিএসআরভুক্ত নয়। আবার বিভিন্ন প্রচার কার্যক্রমে ব্যয়ের অর্থও সিএসআর খাতে দেখানো হচ্ছে। জনতা ব্যাংক বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনকে প্রচারের জন্য দেওয়া অর্থ এ খাতে দেখিয়েছে। এ বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছিলেন, দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালীর সিএসআর কার্যক্রমের টাকা ভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে। এ টাকার একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ব্যাংকটির সিবিএ নেতাদের কল্যাণে। ২০১৩ সালের সিএসআর কার্যক্রমের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে দেখা যায়, বেশিরভাগ ব্যাংক সিএসআর খাতে ইচ্ছেমতো ব্যয় করছে। মোট সিএসআর ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষা উপখাতে ব্যয় করার নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ ব্যাংক শিক্ষায় অর্ধেকও ব্যয় করছে না। শিক্ষা খাতে ব্যাংকের প্রত্যক্ষ অনুদান অনেক কম। অর্থাৎ সিএসআরের একটি মূল উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সমাজের সুবিধা-বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা কাঙ্খিত মাত্রায় উপকৃত হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়েছে ৮ গুণ। ২০০৯ সালে এ খাতে মোট ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৭ কোটি টাকা। লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলোও সিএসআর খাতে ইচ্ছে মতো ব্যয় করে যাচ্ছে। অনেক সময় উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর কাড়া এবং পরিচালকদের মনোতুষ্টি। বিশেষত রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা কোন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী পরিচালকের এলাকায় বেশি পরিমাণে সিএসআর অর্থ দিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির কারণে সরকার ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলো ২০০৮ সালে ৪১ কোটি, ২০০৯ সালে ৫৫ কোটি, ২০১০ সালে ২৩২ কোটি, ২০১১ সালে ২১৮ কোটি ও ২০১২ সালে ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয় করে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, সিএসআর হলো নিয়ম মেনে অনিয়ম করা। দৃশ্যত ভাল কাজ, ভালভাবে হচ্ছে। কিন্তু সেখানেই যত অনিয়ম। এ খাতের টাকা দিয়ে আনন্দভ্রমণ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে নর্তক-নর্তকীও নাচানো হচ্ছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। তবে নীতিমালা না থাকায় অনিয়মের কথা স্বীকার করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, নিট মুনাফা থেকেই সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিৎ। তবে নীতিমালা না থাকায় লোকসানে থাকা ব্যাংকও এ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। তিনি জানান, নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে-যাতে লোকসানে থাকা ব্যাংক সিএসআর কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না বলে উল্লেখ থাকবে। তবে অনুমতি নিয়ে লোকসানে থাকা ব্যাংক ছোট আকারে সিএসআর কার্যক্রম চালাতে পারবে।