মধুমিতা হলে গিয়ে দেখি ‘কিস্তিমাত’ না, চলছে শাকিব খানের ‘কঠিন প্রতিশোধ’। পোস্টারে সেই একই অ্যাকশানে শাকিব খান, অপু বিশ্বাসরা। খোঁজ নিয়ে জানালাম পাশের অভিসারেই চলছে শুভ-আঁচলের কিস্তিমাত। দৌড়ালাম সেখানেই, হলে ঢুকতেই দেখি অ্যাকশান ভঙ্গিমায় শুভর তুমুল এক মারামারি।
পরের দৃশ্যেই কাঁদামাটি মেখে মিশা সওদাগর মাথা ঠাণ্ডা করছেন, দেখলাম নবাগত পরিচালক আশিকুর রহমান মিশা সওদাগরকেও বদলে দিয়েছেন। বুঝলাম যতটুকু ভালো ছবি দেখব বলে হলে আশা করে এসেছি তারও চেয়ে ভালো কিছু নিশ্চয়ই পেতে যাচ্ছি।
আয়েশে সিটে গা এলিয়ে বড় পর্দার সবটা জুড়ে রাখি চোখ। ততক্ষণে আমাদের নায়িকা আঁচল হাজির। কাহিনীতে এক মাঝারি মানের মডেল সে, নামি মডেল হবার আশায় খুচরো নানা কাজ করে বেড়ায়। ক্যারিয়ারে এখনও কোনো ব্রেকিং আসেনি। কিন্তু পর্দার প্রথম দৃশ্যেই সে দর্শকের হৃদয়ে ধাক্কা দেন তাতে হৃদয় ব্রেক ফেল না করলেও ব্রেক তো কষবেই!
আর নায়ক নায়িকার প্রথম দেখা হওয়ার দৃশ্যে পরিচালক যে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। অসম্ভব মধুময় সেই দৃশ্যখানা সত্যিই মনোমুগ্ধকর, বিশেষ করে তারুণ্যের জন্য তো বটেই।
পুরো ছবিটায় চোখ ভরে দেখবার মত শুভ’র অভিনয়। বিশেষ করে অ্যাকশান দৃশ্যগুলোতে যে অসাধারণ অভিনয় শুভ করেছেন তা বাংলা সিনেমায় প্রথম স্থান রাখার দাবিদার। তবে শুভর মজাদার সংলাপের ক্ষেত্রে কাহিনীকার যিনি পুরো চিত্রনাট্যটাই লিখেছেন সেই কাশেম আলী দুলাল সত্যজিত রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র হীরক রাজার দেশের ‘গুপি গাইন, বাঘা বাইন’ এর ছায়া না রাখলেও পারতেন। তবে শুভর অভিনয় দক্ষতায় এই অনুসরণটা অতটা নজরে আসে না, যতটা ভুল হাসপাতালের কোমায় থাকা রোগীর দৃশ্যধারণে পরিচালক করেছেন। কোমায় থাকা রোগীকে কোন হাসপাতালে এইরকমভাবে রাখা হয় জানার বড় ইচ্ছা, তাহলে বড় অঙ্কের চিকিৎসার খরচ জাতিকে মুক্তি দেয়া যেত!
তবে সৌভাগ্য যে, এরকম বড় অসঙ্গতি পুরো ছবিতে তৃতীয়টি নেই, কিন্তু দ্বিতীয়টি রয়েছে। সেটা না হয় আপনারা হলে গিয়েই বুঝে নেন। তবে সেই গলদ আবিষ্কার করলেও এটুকু নিশ্চয়তা দেয়া যায় যে, কিস্তিমাত আপনাকে বাংলা চলচ্চিত্র দেখার পুরনো সব অভিজ্ঞতাকেই পাল্টে দেবে।
কিস্তমাতের গানগুলোও অসাধারণ। একটি আইটেম গানসহ ছবিটির ৫টি গানই কথা, সুর আর দৃশ্যয়নে এককথায় চমৎকার। আঁচলের অভিনয় দক্ষতার সবটুকুই যেন গানের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। এক্ষেত্রে গীতিকার জাহিদ হাসান অভি, সুরকার শওকত আলী ইমন, ইমরান, নাভেদ, শুচি শামস, কোরিওগ্রাফি তানজিল ও সালাম প্রশংসার দাবিদার।
কিস্তিমাতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান এর আইটেম গানটি, যার কোরিওগ্রাফি করেছেন শিবরাম শর্মা। এত অসাধারণ দৃশ্যায়ন এবং অভিনয় যে একটা আইটেম গানের ক্ষেত্রে হতে পারে আগের দেখা বাংলা ছবির গানগুলো দেখে ভাবা বিস্ময়কর। আইটেম গান মানেই যে অশ্লীল দৃশ্য সে ধারণা থেকে বাংলা ছায়াছবি মুক্তি দেবার জন্য পরিচালক ফের ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
খলনায়কের ভূমিকায় মিশা সওদাগর এককথায় ছবিতে অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করেছেন। আফসোস লাগে এত শক্তিমান একজন অভিনেতার অভিনয় কেবল কাহিনীর গতানুগতিকার কারণে তার অপার সম্ভাবনাময় দক্ষতাকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করে চলছে। তারপরও কাহিনীতে যেটুকু নতুনত্ব রয়েছে সেটুকুতেই মিশা বুঝিয়ে দেন তার ক্ষমতাকে।
কিস্তিমাত অভিনেতাদের অভিনয়, দৃশ্যায়ন সমস্ত দিক দিয়ে দর্শকের চাহিদার সবটুকু পূরণ করলেও এর সবচেয়ে দুর্বল দিক এর কাহিনী। পরিচালক আশিকুর রহমান আশা করি তার ভবিষ্যৎ সিনেমায় কাহিনীর দিকে অধিক মনোযোগ দেবেন। তিনি আশা করি মাথায় রাখবেন বাংলা সিনেমার দর্শক নীতিবান বাপ শয়তানের হাতে মরার পর ছেলে তার প্রতিশোধ নেবে এমন কাহিনী দেখতে দেখতে ক্লান্ত। মার খেয়ে শেষ হয়ে যাবার পরও মায়ের আকুল আবেদনে ছেলের জেগে উঠে সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে দেয়া খুবই একঘেয়ে দৃশ্য। কাহিনীর এই ক্ষতিটুকু থাকলেও পুরো ছবিটায় ক্যামেরার কাজ, সিনেমাটোগ্রাফি সব মিলিয়ে কিস্তিমাত শেষতক বাংলা সিনেমায় বাজিমাৎ করেছে সেটুকু নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
খামখেয়ালি পুলিশ অফিসার দুর্জয় রূপে শুভ আর উঠতি মডেল হিসেবে প্রিয়া বা বাস্তবের আঁচলের রসায়ন যে শতভাগ সফল তা হলের দর্শকদের হইরইই প্রমাণ করে দিয়েছে। নবাগত পরিচালক হিসেবে পরিচালক আশিকুর রহমান যে কিস্তিমাতের মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় বাজিমাৎ করেছেন তা হলে গেলেই প্রমাণ পাবেন।
চলচ্চিত্র টিম
পরিচালনা ও চিত্রগ্রহণ-আশিকুর রহমান।কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ-কাশেম আলী দুলাল।অভিনয়-আরিফিন শুভ, আঁচল,মিশা সওদাগর, টাইগার রবি,ইলিয়াস কোবরা প্রমুখ।প্রযোজক- কামাল হাসান।গীতিকার- জাহিদ হাসান অভি। সুরকার-শওকত আলী ইমন,ইমরান,নাভেদ,শুচি শামস।কোরিওগ্রাফি-তানজিল,সালাম।সেট ডিজাইন- ফরিদ। ফাইট ডিরেক্টর-ভাতিজা চুন্নু।